গৌর মাথা নেড়ে বলল, “না, বসব না। আমার কিছু হয়নি।”
“পারবি তো?”
“খুব পারব।”
পরের গেম শুরু হল। ন’পাড়ার দলটা একটু মনমরা বটে, কিন্তু ওদের চোখ ধকধক করে জ্বলছে। আর সকলেরই দৃষ্টি প্রতিপক্ষের একজনের ওপর। সে হল গৌর। গৌর যে এই বাঁশডলা খাওয়ার পর এখনও দাঁড়িয়ে আছে এবং আবার খেলার জন্য তৈরি হচ্ছে, এটা যেন তাদের বিশ্বাসও হচ্ছিল না, তারা সইতেও পারছিল না। সবচেয়ে বেশি ছটফট করছিল মাউ আর খাউ। পারলে তারা যেন ছিঁড়ে খায় গৌরকে।
খেলা শুরু হল। প্রথম ন’পাড়ার দান। যে দানবটা প্রথম দান দিতে এসে গৌরকে জোড়পায়ে লাথি মারার চেষ্টা করেছিল এবারও সে-ই আসছে। ডু…উ…উ..’ বলে ডাক ছেড়ে সে লাফিয়ে এল গৌরদের কোর্টে। তবে এবার আর গৌরকে লাথি মারার মতো ৬৪
বোকামি করল না। খেলার ভান করে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল। গৌর স্থির দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখছিল। মাউ আর খাউয়ের সঙ্গে লোকটার চেহারার বেশ মিল আছে। তবে এ আরও বেশি লম্বাচওড়া এবং আরও বেশি নিষ্ঠুর প্রকৃতির।
লোকটা কাউকে ‘মোর’ করতে না পেরে ফিরে যাচ্ছিল। হঠাৎ গৌর লাইন ছেড়ে এগিয়ে এল। বিদ্যুদগতিতে গিয়ে লোকটা লাইন পার হওয়ার আগেই দু’হাতে লোটার কোমর ধরে ফেলল। গৌরের দলের সকলেই হায় হায়’ করে উঠল। এ অবস্থায় লোকটাকে ধরে রাখা অসম্ভব। গৌর আউট হবেই, কারণ লোকটা গৌরের চেয়ে চেহারায় দেড়গুণ এবং লাইনে প্রায় পৌঁছেও গেছে।
কিন্তু গৌর অবিচল। কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সে আচমকা একটা হ্যাঁচকা টানে লোকটাকে প্রায় লাইনের ওপর থেকে টেনে আনল। গৌরের এই দুঃসাহসে লোকটা অবাক। তবে মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে সেও এক ঝটকা মারল। সেই ঝটকায় হাতি অবধি ছিটকে যায়।
কিন্তু গৌরের আজ হল কী কে জানে। সে সেই বিকট ঝটকায় একচুলও টলল না। একটা কোঁত’ শব্দ করে সে লোকটাকে দুহাতে শূন্যে তুলে নিল, তারপর কয়েকটা পাক দিয়ে নিজের কোর্টে মারল এক আছাড়। সেই আছাড়ে মাটি কেঁপে উঠল। চারদিকে এক সূচীভেদ্য নিস্তব্ধতা। কেউ যেন ঘটনাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে । তারপরেই বিপুল উল্লাসে দর্শকরা ফেটে পড়ল।
তেজেন এসে গৌরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “তুই আমাদের সেরা খেলোয়াড় বটে, কিন্তু এরকম খেলা আগে কখনওই তো দেখিনি তোর! হল কী রে গৌর?”
গৌর গম্ভীরভাবে বলল, “আমিও তা জানি না। তবে এবার আমি দান দেব।”
তেজেন একটু দোনোমনো করে বলল, “দে তা হলে। আজ তোর কপালটা ভালই যাচ্ছে।”
কপাল নয়, অন্য কিছু। কিন্তু সেটা যে কী, তা গৌর বুঝতে পারছে না। হঠাৎ যেন শরীরে একশো হাতির জোর জোয়ারের মতো নেমে এসেছে। ঘোড়ার মতো টগবগ করছে হাত-পা। রক্ত গরম। শরীর পালকের মতো হালকা।
সে যখন হানা দিতে ন’পাড়ার কোর্টে ঢুকল তখন তার শরীরে ঘূর্ণিঝড়ের মতো গতি। শব্দ করে দম ছাড়তে ছাড়তে সে একেবারে বিপক্ষ দলের মধ্যে ঢুকে গেল। ন’পাড়ার মুশকো-মুশকো খেলোয়াড়রা তার কাণ্ড দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সকলে একেবারে শেষপ্রান্তে সরে গিয়ে অপেক্ষা করছে।
ডান কোণে দাঁড়িয়ে ছিল মাউ। চোখে উপোসি বাঘের মতো তীব্র দৃষ্টি। হঠাৎ যেন ভোজবাজির মতো মাউয়ের হাতে একটা গজাল এসে গেল কোথা থেকে। এমন কৌশলে সেটা হাতের পাতায় ঢেকে রেখেছে মাউ যে, কারও চোখে পড়ার কথা নয়। কিন্তু গৌর ঠিকই দেখতে পেল।
বাঁ দিকে একটু ঢেউ খেয়ে গৌর সোজা মাউয়ের দিকেই এগিয়ে গেল। পা বাড়িয়ে একটা ভড়কি দিয়েই সরে এল। ফের ডান দিকে ঝুল খেল। সবাই ভাবছে এবার সে ডান দিকে সরে যাবে। কিন্তু গৌর আবার বাঁ দিকে বিদ্যুদগতিতে এগিয়ে গিয়ে মাউকে বাঁ হাতে মোর করে দিল। কিন্তু মোর হয়েই মাউ লাফিয়ে পড়ল তার ওপর। হাতে লুকোনো গজাল।
গৌর শুধু হাতটা নজরে রেখেছিল। গজালসুষ্ঠু হাতটা সোজা এগিয়ে এসেছিল তার পেটের দিকে। গৌর শরীরটা সরিয়ে নিয়ে হাতটা ধরে ফেলল, ঠিক যেমনভাবে নিপুণ সাপুড়ে বুনো সাপ ধরে। সঙ্গে সঙ্গে একটা মোচড়।
পাটকাঠির মতো মাউয়ের হাতটা যে ভেঙে যাবে, তা গৌর স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। মাউয়ের চেহারা বিশাল, গায়ে দানবের মতো জোর। এই সেদিনও গৌরকে মনের সুখে মেরেছে। গজালটা পড়ে গেল হাত থেকে। বাঁ হাতে ডান হাতটা চেপে ধরে বাপ রে’ বলে চেঁচিয়ে বসে পড়ল মাউ। চারদিকে একটা হইহই উঠল। “গজাল! গজাল! …এ তো খুনখারাপির মতলবে ছিল! বের করে দাও! ন’পাড়া হেরে গেছে। …দুয়ো… দুয়ো..”
কিন্তু লোকে চেঁচালে হবে কী?ন’পাড়ার উদ্দেশ্য তো খেলা নয়। মাউ পড়ে যেতেই নপাড়ার বাকি ছ’জন আবার লাফিয়ে পড়ল গৌরের ওপর।
গৌর পড়ে গেল না, ঘাবড়াল না। সাবধানে দমটা ধরে রেখে সে শরীরে একটা ঘূর্ণি তুলল আবার। চরকির মতো বোঁ বোঁ করে ঘুরপাক খেতে লাগল সে। আর ঘূর্ণাবেগে ন’পাড়ার বিশালদেহী খেলোয়াড়রা ছিটকে ছিটকে যেতে লাগল এদিক-সেদিক। দু’জন গিয়ে পড়ল কোর্টের বাইরে, একজন দর্শকদের মধ্যে।
গৌর সবাইকে আউট করে নিজের কোর্টে ফিরে আসতেই এমন তুমুল হাততালি আর হর্ষধ্বনি উঠল যে, কানে তালা ধরার উপক্রম।
দর্শকদের সেই উল্লাস ছাপিয়ে একটা রাজকীয় গুরুগম্ভীর গলা থেকে একটামাত্র শব্দ বেরিয়ে এল, “শাবাশ!”
গৌর তাকিয়ে হিম হয়ে গেল। যে-টেবিলে প্রাইজ রাখা আছে, তার ও-পাশে দাঁড়িয়ে রাজা রাঘব। প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, সাদা একটা জোব্বার মতো পোশাকে তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।