ওই বিশাল দানবীয় চেহারার জোড়া লাথি বুকে লাগলে পাজরের হাড় মড়মড় করে ভেঙে যাওয়ার কথা। কিন্তু গৌর নিজে ভাল খেলোয়াড়, গায়ের জোরে দানবটার সঙ্গে পাল্লা টানতে পারলেও সে দারুণ চটপটে, দ্রুতগতি। পা দুটো যখন তার বুকের ওপর নেমে আসছে, তখন সে খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। এ-খেলায় ছোঁয়াছুঁয়ি আছে বটে, কিন্তু ধরা পড়ার ভয় না-রেখে কেউ যে এ রকম বেহেড হয়ে কারও ওপর লাফিয়ে পড়তে পারে, এ-ধারণা তার ছিল না। তাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে সে চট করে বাঁ দিকে শরীরটা বাঁকিয়ে পাঁকাল মাছের মতো সরে গেল। দানবটা তাকে পেরিয়ে গদাম করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। গৌরই গিয়ে ধরে তুলল তাকে। অবাক হয়ে বলল, “এ কেমনধারা খেলা?”
লোকটা কুটি করে বলল, “এখনই কী? খেলা দেখবে।”
একটা লোক আউট হওয়ায় ন’পাড়ায় কোনও বৈলক্ষণ্য দেখা গেল না। পরের দান গৌরের, গৌর চোখ বুজে ঠাকুর স্মরণ করে বুকভরে দম নিল। তারপর ভিমরুলের মতো ডাক ছেড়ে হালকা পায়ে গিয়ে ঢুকল ন’পাড়ার কোর্টে। তেজেনের চেয়ে সে বহুগুণ দ্রুতগতি, অনেক বেশি তার গায়ের জোর। সে অনেক উঁচুতে লাফাতে পারে, শরীরে নানারকম অদ্ভুত মোচড় দিতে পারে। এ-খেলায় সেইটিই দরকার। গৌর ঢুকেই চটপট ডাইনে বাঁয়ে একটু বিদ্যুতরঙ্গের মতো নিজেকে বইয়ে দিল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, ন’পাড়ার খেলোয়াড়গুলো আসলে খেলোয়াড় নয়, খুনে, কেন মনে হল কে জানে!
ডান থেকে বাঁয়ে, বাঁ থেকে আবার ডান দিকে ঘুরে যাওয়ার মুখেই এক পায়ের ওপর শরীরটাকে রেখে আর-এক পা চকিতে বাড়িয়ে লাইনে দাঁড়ানো একজন মুশকো চেহারার লোককে ছুঁয়ে দিল। আউট। গৌর চোখের পলকে বাতাসে শরীর ভাসিয়ে একটা লাফ মারল নিজের কোর্টের দিকে।
কিন্তু মাটিতে পড়তে পারল না গৌর, মুশকো লোকটা মোর হয়ে তখন মরিয়া। সেও এক লাফে এগিয়ে এসে গৌরের কোমরটা দু’হাতে জাপটে ধরে পেড়ে ফেলল মাটিতে। কিন্তু গৌর পাকা খেলোয়াড়। এই হুটোপাটিতেও দম হারায়নি। ডাক ছাড়তে ছাড়তেই সে লাইনের দিকে খানিকটা গড়িয়ে গেল লোকটাকে জাপটে ধরেই।
কিন্তু ন’পাড়ার খেলুড়েরা তখন কটা মস্ত মস্ত পাথরের মতো গদাম গদাম করে এসে তার ওপর পড়ছে। এ-খেলায় হুটোপাটি হয়ই। কিন্তু মারদাঙ্গার তো নিয়ম নেই। কিন্তু গৌর বুঝতে পারছিল, তাকে আউট করার ছল করে কে যেন লোহার হাতে তার গলার নলি টিপে ধরেছে। আর-একজন ঘুসি চালাচ্ছে কানের পিছনে। কে যেন হাঁটু দিয়ে তার বুকের পাঁজর ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কনুই দিয়ে কে যেন মারল তার পেটে। একটা লাথি এসে জমল তার মুখে।
অন্য কেউ হলে এতক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যেত। কিন্তু গৌর অনেক
কষ্ট করে বড় হয়েছে। ব্যথাবেদনা তাকে কাবু করতে পারে না। শরীরটাও তার যথেষ্ট সহনশীল। তাই অতগুলো লোকের জাপটাজাপটি এবং আক্রমণের মধ্যেও সে দম ধরে রেখে ইঞ্চি-ইঞ্চি করে এগোতে লাগল লাইনের দিকে। যেন পাহাড় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে তার, মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু সে জানে, ন’পাড়ার এই লোকগুলো খেলোয়াড়ই নয়, এরা চায় তাকে খুন করতে। খেলায় হারজিত নিয়ে এরা মাথা ঘামায় না।
চারদিকে খুব চেঁচামেচি হচ্ছিল। গৌর লক্ষ করল, কে যেন তাকে। আটকাতে না পেরে তার চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। হাতের অনামিকায় পলার আংটিটা দেখে চিনল গৌর। মাউ। মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল গৌর। বুক ফেটে যাচ্ছে, তবু দম না ছেড়ে সে একবার শেষ চেষ্টায় শরীরে একটা ঢেউ দিল। সামান্য আলগা হল কি পিঠের ওপর পাহাড়টা? তবে গৌর দেখল, খুব চেষ্টা করলে তার আঙুল লাইনটা ছুঁয়ে ফেলতে পারে।
‘ডু…উ…উ..’ করে বুকের তলানি বাতাসটুকু উজাড় করে দিয়ে গৌর মাটির ওপর নিজেকে ঘষে দিয়ে এগোল। এগোতেই হবে। ডান হাতখানা আকুলভাবে বাড়িয়ে দিল লাইনের দিকে।
লাইনটা ছুঁল কি না বুঝতে পারল না গৌর, তবে একটা বিশাল চিৎকার উঠল চারদিকে। গৌরের চোখে সেই সময়ে নেমে এল নিবিড় অন্ধকার। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
যখন জ্ঞান ফিরে এল, তখন তার সর্বাঙ্গ জলে ভেজা। কোর্টের ধারে তাকে শুইয়ে ক্ষতস্থানে ওষুধ মাখাচ্ছেন কবরেজমশাই। ক্ষত হয়েছেও বড় কম নয়। বুক আর হাতের অনেকটা ছাল উঠে গেছে। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে, নাক ভেঙে গেছে, কানের পিছনে মাথাটা ফুলে ঢোল, কপালের অনেকটা ছড়ে গেছে। চারদিকে ভিড়ে ভিড়াক্কার।
গৌর প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, “আমার দানটার কী হল?”
কে একজন চেঁচিয়ে বলল, “ওঃ, যা দেখালে খেলা একখানা বাপ! এক দানে ন’পাড়ার গোটা দল আউট!”
শুনেই গৌরের রক্ত গরম হয়ে গেল। শরীরের ব্যথাবেদনা যেন উড়ে গেল ফুকারে। সে একলাফে উঠে পড়ে বলল, “আমি পরের গেম খেলব।”
ন’পাড়া কী চায় তা গৌর বুঝে গেছে। সে বুঝে গেছে, রাজা রাঘবের আদেশে ন’পাড়ার সাত খুনি সব খেলুড়েকে ছেড়ে শুধু তার ওপরেই চড়াও হবে। এই খেলার লক্ষ্যই হল গৌর। কিন্তু গৌরের আর ভয় করছিল না।
তেজেন তার অবস্থা দেখে চিন্তিত মুখে বলল, “এ কি খেলা নাকি? এ তো খুনখারাপি! তোকে আর খেলতে হবে না, বসে যা।
একটা গেম তো একাই জিতিয়ে দিয়েছিস, এখন বসে জিরো।”