“সোনার মেডেল দেবে সত্যি?”
“সোনার মেডেল, টাকা, তার ওপর পোলাওকালিয়া দিয়ে
ভোজ।”
“এর মধ্যে কোনও গোলমাল নেই তো?”
“গোলমাল আর কী থাকবে? বিশে নিজে আজ ন’পাড়ায় গিয়ে দেখে এসেছে সেখানে সাজো-সাজো রব, রঙিন কাগজ দিয়ে সারা গাঁ সাজানো হয়েছে। কালীবাড়ির সামনের চাতালে বিশাল উনুন তৈরি হচ্ছে, বত্রিশটা পাঁঠাবলি হয়ে গেছে, হাঁড়ি-হাঁড়ি দই-মিষ্টি আসছে ঘোষপাড়া থেকে।”
দলের সকলেরই ভারী ফুর্তি, জোর কদমে হাসাহাসি আর গল্পসল্প করতে করতে হাঁটছে সবাই।
গৌর হঠাৎ তেজেনকে জিজ্ঞেস করল, “আর হেরে গেলে কী দেবে?”
তেজেন বলল, “সেকথাও হয়েছে, হারলে পাঁচ টাকা করে পাবে সবাই। খাওয়া তো থাকছেই। তবে ভাবছিস কেন, আশপাশের দশখানা গাঁয়ে আমরাই সেরা। ন’পাড়ার ছেলেদের গায়ে যত জোরই থাকুক, আমাদের মতো কায়দা জানে না। হেরে ভূত হয়ে যাবে।”
কিন্তু গৌর তেজেনের মতো নিশ্চিন্ত হল না। তার মনে কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। এই যে হুট করে খেলার আয়োজন, এত প্রাইজ আর মেডেলের লোভানি, এটাকে খুব স্বাভাবিক ঘটনা বলে ভাবতে পারছে না সে।
ন’পাড়ায় ঢুকে তার অস্বস্তিটা বরং বাড়ল। বাস্তবিকই এ-পাড়াকে আজ চেনা যায় না। গাছে গাছে রঙিন ফেস্টুন, রঙিন কাগজের শিকলি, নিশান, কালীবাড়িতে ব্যান্ড পার্টিও এসেছে, দারুণ বাজনা বাজছে সেখানে।
কালীবাড়ির পাশেই খেলার মাঠে কোর্ট কাটা হয়েছে। লোকে লোকারণ্য, গৌররা সেখানে যেতেই একদল বাচ্চা মেয়ে এসে সবাইকে মালা পরিয়ে দিল, কপালে দিল চন্দনের ফোঁটা, এই সব দেখে সকলেই কেমন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
কোর্টের পাশেই সুন্দর করে সাজানো টেবিলে ছোট ছোট নীল ভেলভেটের বাক্সে সোনার মেডেলগুলো ঝকঝক করছে। টেবিলের ওধারে চারটে চেয়ারে চারজন বেশ সম্রান্ত চেহারার মানুষ বসে আছেন।
গৌররা ঢুকতেই সকলে হাততালি দিয়ে হর্ষধ্বনি করে উঠল। তেজেন গৌরের কানে কানে বলল, “আজ জিততেই হবে গৌর।”
“চেষ্টা করব।”
“জিতে না ফিরলে প্রেস্টিজ থাকবে না, মনে রাখিস।”
খেলা শুরু হতে একটু দেরি আছে; দু’পক্ষের টিম এসে মাঠের ধারে জড়ো হয়েছে সবে। একটা দৃশ্য দেখে সকলে অবাক। ন’পাড়ার খেলোয়াড়দের মধ্যে মাউ আর খাউ রয়েছে।
তেজেন ন’পাড়ার ক্যাপটেনের কাছে গিয়ে আপত্তি জানাল, “ওরা তো আমাদের গাঁয়ে থাকে, ওরা তোমাদের হয়ে খেলছে কেন?”
ন’পাড়ার ক্যাপটেন বলল, “মোটেই তোমাদের গাঁয়ের লোক নয় ওরা, কুটুমবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে এই মাত্র। তোমরা ওদের টিমেও নাওনি, তাই আমরা হায়ার করেছি।”
তেজেন আর যুক্তি খুঁজে না পেয়ে ফিরে এসে গৌরকে চুপিচুপি বলল, “তোর কুটুমরা ও-দলে খেলছে, ব্যাপারটা একটু গোলমেলে।”
“তা-ই দেখছি।”
গৌরের বুকের ভিতরটা একটু ঢিপঢিপ করতে লাগল। মাউ আর খাউ নপাড়ার হয়ে খেলছে খেলুক, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু রাঘবরাজা ওদের যে হুকুমটা দিয়েছে, সেটা মনে করেই গৌরের হাত-পা হিম হয়ে আসছিল। তার মনে হচ্ছিল, খেলায় না নেমে ফিরে গেলেই বোধহয় ভাল হত। মাউ আর খাউয়ের মতলব হয়তো ভাল নয়।
কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। মালা পরে চন্দনের ফোঁটা নিয়ে পিছিয়ে গেলে সবাই দুয়ো দেবে। তাদের গাঁ থেকেও অনেকে খেলা দেখতে এসেছে, তারাই বা মনে করবে কী? ভিড়ের মধ্যে গৌর কবরেজমশাই, ফকিরসাহেব, গোবিন্দদা, সবাইকেই দেখতে পেল।
শরীরের আড় ভাঙার জন্য কোর্টে নামার আগে একটু ডনবৈঠক করে গা ঘামিয়ে নিচ্ছিল সবাই। এমন সময় কবরেজমশাই এগিয়ে এসে একটা ছোট্ট শিশি গৌরের হাতে দিয়ে বললেন, “চটপট তেলটুকু মেখে নে। হাতে-পায়ে আর ঘাড়ে ভাল করে মাখিস।”
“এ মেখে কী হবে কবরেজমশাই?”
“হবে আমার গুষ্টির পিণ্ডি, যা বলছি, চোখ বুজে করে যা। আজ তোর বড় ফাঁড়া।”
গৌর আর দ্বিরুক্তি না করে তেলটা মেখে ফেলল। ভারী অদ্ভুত তেল। জলের মতো পাতলা, মাখতেই শরীরে মিশে গেল। কোনও তেলতেলে ভাব অবধি থাকল না।
খেলা শুরু হল। প্রথম দান গৌরদের। তেজেন দম নিয়ে ‘ডু…উ..উ..উ…’ডাক ছেড়ে ঢুকে গেল নপাড়ার এলাকায়। দু’হাত পাখির ডানার মতো ছড়ানো, হালকা পায়ে উড়ে উড়ে কোর্টের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত যেতে যেতে হাত দিয়ে তীব্র কয়েকটা ছোবল ছুড়ল সে, চকিতে পা বাড়িয়ে দিল এদিক-সেদিক। না, ন’পাড়ার কেউ ‘আউট’ হল না।
তেজেন নিজের কোর্টে ফিরে আসতে না আসতেইন’পাড়ার এক বিশাল চেহারার কালো জোয়ান পাহাড়ের মতো ধেয়ে এল। বিকট ‘ডু…উ..উ..’শব্দ করতে করতে কোর্টে ঢুকে পড়তেই গৌর বুঝে গেল, লোকটা আনাড়ি। চেহারা বিশাল হলেই তো হয় না। এ-খেলায় চটপটে হওয়া এবং কূটকৌশল জানা একান্ত দরকার।
এ-লোকটার তা নেই, এক্ষুনি ধরা পড়ে যাবে। গৌর প্রস্তুত হল।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, লোকটা কাউকে আউট করার জন্য হাত-পা খেলানোর চেষ্টাই করল না। বিপক্ষের কোর্টে ঢুকে সে একটু থমকে দাঁড়িয়ে হঠাৎ প্রবল আক্রোশে আর প্রতিহিংসায় সোজা এগিয়ে এল গৌরের দিকে।
গৌর নোকটার কাণ্ড দেখে অবাক। তেজেন এবং তার দলবল চারদিক থেকে ঘিরে ধরে জাপটেও ফেলল লোকটাকে। কিন্তু দানবের মতো লোকটা দু তিন ঝটকায় সবাইকে ঝেড়ে ফেলে জোড়পায়ে একটা তুর্কি লাফ মেরে লাফিয়ে পড়ল গৌরের ওপর।