“পালিয়ে কি বাঁচতে পারবে গৌর? যেখানেই যাও, রাজা রাঘবের গুপ্তঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পাবে না।”
“আপনি কে?”
“আমি তোমার একজন মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। এখন যা বলছি, শোনো। রাজা রাঘবের ক্ষমতা অনেক। তার মতো নৃশংস মানুষও হয় না। এই জায়গায় একসময়ে তার পূর্বপুরুষেরা রাজত্ব করত। অনেক দিন আগেই সেই রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। রাঘব আবার সেই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমরা কিছু লোক সেটা ঠেকাতে চাইছি। কেন জানো?”
লোকটা যে-ই হোক, এর কথাবার্তা শুনে গৌরের মনে হল, লোকটা শত্রু নয়। সে একটু ভরসা পেয়ে বলল, “আজ্ঞে না। বলুন।”
“রাঘবের পূর্বপুরুষেরা ছিল সাংঘাতিক অত্যাচারী। কেউ সামান্য বেয়াদবি করলেই তার গলা কেটে ফেলে দিত। আসলে ওরা রাজত্ব তৈরি করেছিল ডাকাতি করে। রাজা হয়েও সেই ডাকাতির ভাবটা যায়নি। প্রায় একশো পঁচিশ বছর আগে একদল প্রজা খেপে গিয়ে মরিয়া হয়ে প্রাসাদ আক্রমণ করে। প্রাণভয়ে রাজা আর তার আত্মীয়রা পালায়। বিদ্রোহী প্রজার হাতে কয়েকজন মারাও পড়ে। তখন যে রাজা ছিল তার নাম মাধব। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এই বেয়াদবির শোধ সে নেবেই। সে না পারলেও তার বংশের কেউ-না-কেউ ফিরে এসে এখানে আবার রক্তগঙ্গা বইয়ে রাজ্য স্থাপন করবে।”
গৌর জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই লম্বা লোকটাই কি রাঘব?”
“হ্যাঁ। সাংঘাতিক লোক। রাঘব না-পারে এমন কোনও কাজ নেই। ওর চেহারাটা রোগা বটে, কিন্তু লোহার মতো শক্ত। যে-কোনও বড় পালোয়ানকে ও পিষে মেরে ফেলতে পারে। আর শুধু গায়ের জোরই নয়, ওর কিছু অদ্ভুত ক্ষমতাও আছে। ও চোখের দৃষ্টি দিয়ে যে-কোনও মানুষকে একদম অবশ করে দিতে পারে। নানারকম দ্রব্যগুণও ওর জানা আছে। ওর টাকাপয়সাও অনেক। যেখানে যত ভয়ংকর, নিষ্ঠুর, পাজি আর বদমাশ আছে, তাদের ও একে-একে জোগাড় করছে। সেই সব লোককে নিয়ে একটা দল তৈরি করে একদিন ঝাঁপিয়ে পড়বে এই গ্রাম আর আশপাশের পাঁচ-সাতখানা গাঁয়ের ওপর। গাঁয়ের পর গাঁ জ্বালিয়ে দেবে, বহু মানুষকে কচুকাটা করবে। তারপর নিজের দল নিয়ে রাজত্ব করবে। বুঝেছ?”
গৌর কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বুঝেছি। কিন্তু আমাকে যে মারবার হুকুম দিয়ে গেল, আমি এখন কী করি?”
“ভয় পেয়ো না। পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। একটু সতর্ক থেকো, তা হলেই হবে। আর তোমার কবচটাকে ঠিকমতো ব্যবহার কোরো।”
কবচ! কবচের কথা গৌর ভুলেই গিয়েছিল। কোমরে হাত বুলিয়ে কবচটা ছুঁয়ে দেখে সে বলল, “কিন্তু গোবিন্দদা বলছিল, কবচটা নাকি ঘুমন্ত। এটাকে না জাগালে কাজ হবে না।”
“গোবিন্দ ঠিকই বলেছে।”
“তা কবচটাকে জাগাব কী করে?”
“সে ঠিক সময়মতো জানতে পারবে।”
“এখন আমি কী করব তা হলে?”
“যেমন আছ তেমনি থাকবে। চারদিকে চোখ রেখে চলবে।”
“আপনি কে?”
“আমি রাজা রাঘবের শত্রু, এর বেশি আজ আর বলব না।”
“আমবাগানে কে একজন আমার দিকে একটা টাকা ছুঁড়ে দিয়েছিল, সে কি আপনি?”
কেউ একথার জবাব দিল না। গৌর চেয়ে দেখল, জানালার ধারে ছায়ামূর্তিটা নেই।
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুটুলি খুলে ধুতি আর গেঞ্জি যথাস্থানে রেখে দিল।
৫. একটা ছেলে এসে গৌরকে খবর দিল
পরদিন সকালেই একটা ছেলে এসে গৌরকে খবর দিল, বিকেলে ন’পাড়ার সঙ্গে দারুণ হাডুডু ম্যাচ। এরকম কোনও ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু ন’পাড়ার কোন বড়লোক নাকি এই হাডুডু ম্যাচের জন্য টাকা দিচ্ছেন। যে-দল জিতবে, তার প্রত্যেক খেলোয়াড় একটা করে সোনার মেডেল আর নগদ পঞ্চাশ টাকা পাবে। তা ছাড়া খেলার শেষে বিরাট ভোজের ব্যবস্থা হয়েছে।
খবরটা পেয়ে গৌরের ভারী আনন্দ হল। সোনার মেডেল, টাকা, এ-সব তার কাছে স্বপ্নের মতো। হাডুডু সে ভালই খেলে। তার দম অফুরন্ত, গায়ে জোরও সাংঘাতিক। চটপটেও সে বড় কম নয়। গাঁয়ের দলের সে-ই সবচেয়ে ভাল খেলোয়াড়।
সারাদিনটা মেডেল আর টাকার কথা চিন্তা করে মনটা বেশ
উড়ুউড়ু হয়ে যাচ্ছিল তার। আবার মাঝে মাঝে কেমন যেন একটা আবছা ভয়ও হচ্ছিল। ন’পাড়া তাদের পাশের গ্রাম। বেশি দুর নয়। তবে ন’পাড়ার সঙ্গে তারা কখনও খেলেনি। গ্রামটার খুব বদনাম আছে ডাকাতের গাঁ বলে। ন’পাড়ার নামে লোকে ভয়ে কাঁপে। লটকা, কচি বেত বা কামরাঙার খোঁজে বন্ধুদের সঙ্গে কয়েকবার ন’পাড়া গেছে গৌর। গাছপালায় ঘেরা অন্ধকার গা-ছমছমে পরিবেশ। একটা হাজার বছরের পুরনো কালীবাড়ি আছে। সেখানে এখনও রোজ পুজো হয়। ঠ্যাঙাড়ে ডাকাতরা নাকি এই কালীকেই পুজো দিয়ে ডাকাতি করতে বেরোয়। ন’পাড়ার মানুষগুলোও কিছু অদ্ভুত। প্রত্যেকেরই বেশ মজবুত চেহারা আর প্রত্যেকেই ভীষণ গোমড়ামুখো। দেখলেই ভয় করে। ন’পাড়ার ছেলেরা যে হাডুডু খেলে, এটা গৌর জানতই না, তাই কেমন একটু অস্বস্তি হচ্ছিল তার।
বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে গোরুর জাবনা দিয়ে, ঘরদোরের কাজ চটপট সেরে গৌর গিয়ে দক্ষিণের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে জুটে ন’পাড়া রওনা হল।
তেজেন হল দলের ক্যাপটেন। গৌর তাকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে তেজেন,ন’পাড়ার আবার কবে থেকে খেলাধুলোর শখ হল?”
তেজেন বলল, “কী জানি ভাই, ন’পাড়ার ছেলেরা যে খেলে তা-ই তো জানতাম না। তবে শুনেছি, এক বড়লোক জুটেছে সেখানে। যে নাকি গাঁয়ের চেহারা বদলে দেবে, জলের মতো টাকা ঢালছে।”