“না তো!”
“তা হলে ও কবচটাও পারবে না। ওটাকে জাগাতে হবে।”
“কী করে জাগাতে হয়?”
“সে আমি কী জানি? আমার ছিল কবচ খুঁজে দেওয়ার কথা, দিয়েছি। এখন যার কবচ, সে বুঝবে।”
“কিন্তু না জাগলে আমি জাগাব কী করে?”
গোবিন্দ একটু হাসল। বলল, “সে ঠিকই জানতে পারবি। এখন কোমরে একটা কালো সুতোয় ভাল করে কবচটা বেঁধে রাখ। যেন না হারায়। সময় হলেই কবচকে ঘুম থেকে তোলা হবে। এখন কাজে যা। ঘাটে বাসন ফেলে এসেছিস, একখানা চুরি গেলে তোর বউদি আস্ত রাখবে না।”
গৌর তাড়াতাড়ি ঘাটে ফিরে গেল।
বিকেলবেলায় কবচটা খুব সাবধানে কোমরে বেঁধে নিল গৌর। তারপর গোরুর জাবনা দিয়ে, গোয়ালে সাঁজাল দিয়ে কাজ সেরে ফেলতে গেল।
হাডুডু সে খুবই ভাল খেলে। অফুরন্ত দম, একদমে তিন-চারজনকে মেরে দিয়ে আসে। যাকে জাপটে ধরে, সে আর নিজেকে ছাড়াতে পারে না।
গৌরের দল রোজই জেতে। আজও তারা তিন পাটিই জিতল। কিন্তু জিতেও গৌরের সুখ নেই, বরং উলটে তার ভয় হল। বেশি খেলাধুলো করলে খিদেটাও যে বেশি পায়। রাতের খাওয়া বন্ধ, খিদে পেলে পেটের জ্বালা জল ছাড়া আর কিছু দিয়ে তো মেটানো যাবে না। গোবিন্দদা যদি আজ না আসে বা এলেও যদি রুটি আনতে ভুলে যায়, তা হলে কী হবে?
খেলার পর মাঠের ধারে বসে রোজই গৌর বন্ধুদের সঙ্গে একটু গল্পগাছা করে। আজও করল। তারপর বাড়ি যাবে বলে সবাই যে যার পথ ধরল।
বাজারের কাছ দিয়ে আসার সময় তেলেভাজার ‘ম ম’ গন্ধে গৌর দাঁড়িয়ে গেল। বলতে নেই, তার খিদে পেয়েছে। তেলেভাজার গন্ধে সেই খিদেটা এখন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। হরিপদ আজ হিং দিয়ে আলুর চপ আর ফুলুরি ভাজছে। কী যে বাস ছেড়েছে, সে আর বলার নয়। ইচ্ছে করে, লাফিয়ে পড়ে থাবিয়ে সব খেয়ে নেয়।
কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো হল না। আইনকানুন আছে, সহবত আছে, চক্ষুলজ্জা আছে। গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরিপদর দোকানটা এড়িয়ে বটতলার ঘুরপথটা ধরল। এ-পথটা অন্ধকার, নির্জন। তা হোক, তবু ফুলুরির দোকানের সামনে দিয়ে না যাওয়াই ভাল। তার লোভী চোখের নজর লাগলে ও ফুলুরি আর তেলেভাজা যে খাবে, তারই পেটের অসুখ করবে। ৪৮
বটতলার মহাবীরের থান পেরোলেই আমবাগান। সেখানে জমাট অন্ধকারে থোকা থোকা জোনাকি জ্বলছে। ঝিঝি ডাকছে খুব। সামনেই সরকারদের পোড়ো বাড়ি, যেখানে কন্ধকাটা ভূত আছে বলে সবাই জানে। সন্ধের পর এ-পথে কেউ বড় একটা হাঁটাচলা করে না। গৌর যে খুব সাহসী এমন নয়, তবে গরিবদুঃখীদের ভয়ডর বেশি থাকলে চলে না। সে এগোতে লাগল। গুনগুন করে একটু গান ভাঁজছিল সে, ভয় তাড়ানোর জন্য। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কে রে?”
তার স্পষ্ট মনে হয়েছে, অন্ধকারে আগে আগে কে যেন হাঁটছে। এখনও চাঁদ ওঠেনি। অমাবস্যা চলছে। কিন্তু আকাশ থেকে যে ঝাঁপসামতো একটুখানি আভা-আভা আলো আসে, তাইতেই তার মনে হয়েছে, একটা সরু লোক, স্পষ্ট বোঝা যায়নি অবশ্য। কিন্তু লোকটা জবাব দিল না।
গৌর আবার হাঁটতে লাগল। আমবাগানের সঁড়িপথে ঢুকতে যাবে, এমন সময় আবার মনে হল, সামনেই কেউ একটা আছে। পায়ের শব্দ হল যেন।
“কে ওখানে?” কেউ জবাব দিল না। কিন্তু হঠাৎ ঠন করে কী একটা জিনিস যেন এসে পড়ল গৌরের পায়ের কাছে। সে প্রথমটায় চমকে উঠেছিল। তারপরে সাহস করে নিচু হয়ে মাটি হাতড়ে গোলমতো একটা জিনিস পেয়ে তুলে নিল। জিনিসটার ওপর হাত বুলিয়ে আন্দাজে বুঝল, একটা কাঁচা টাকা।
ভয়ে গৌর আর এগোতে পারল না। টাকাটা মুঠোয় নিয়ে পিছু হটে আবার বাজারে চলে এল। দোকানের আলোয় মুঠো খুলে দেখল, টাকাই বটে। কিন্তু টাকাটা তার দিকে ছুঁড়ে দিল কে? আর দিলই বা কেন? অনেকক্ষণ ভেবেও সে প্রশ্নের জবাব পেল না। তবে মনে হল, টাকাটা যখন পাওয়াই গেছে, তখন খরচ করতে দোষ নেই। যে-ই দিয়ে থাক, সে গৌরের খিদের কথা জানে।
হরিপদর দোকানে গিয়ে গরম-গরম ফুলুরি আর আলুর চপ খেল গৌর। শ্রীদাম ময়রার দোকান থেকে রসগোল্লাও খেল। টাকাটা কে দিল তা ভাবতে ভাবতে একটু অস্বস্তি নিয়েই বাড়ি ফিরল গৌর। নিতাইগোপাল তার দুই শালাকে নিয়ে খেয়ে উঠে আঁচাচ্ছে। তার দিকে চেয়ে গম্ভীর মুখে বলল, “তৈরি হ’। রাতে পাহারা দিতে হবে মনে থাকে যেন।”
গৌর মাথা নেড়ে নিজের ঘরে গিয়ে লাঠিগাছা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল।
ক্রমে রাত নিশুতি হয়ে এল। সবাই অঘোর ঘুমে। গৌর একা দাওয়ায় বসে লাঠি ঠুকে ঠুকে পাহারা দেওয়ার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে উঠে চারদিকটা ঘুরেও আসছে। হুয়া-হুঁয়া করে একঝাঁক শেয়াল ডেকে উঠল কাছেই, দীর্ঘ বিষণ্ণ সুরে একটা কুকুর কাঁদতে লাগল। রাতের আরও সব বিচিত্র শব্দ আছে। কখনও তক্ষক ডাকে, কখনও পাচা, কখনও বাঁশবনে হাওয়া লেগে মচমচ শব্দ ওঠে, কখনও গুপুস করে পুকুরে ঘাই মারে বড় বড় মাছ। ঝিঝি ডাকে, কোনও বাড়ির খোকা হঠাৎ ওঁয়া-ওঁয়া করে কেঁদে ওঠে। শব্দগুলি সবই গৌরের চেনা। তবু আজ তার একটু গা-ছমছম করতে লাগল। তাকে ঘিরে যেন ক্রমে-ক্রমে একটা রহস্যের জাল বোনা হচ্ছে। কে বুনছে? কে সেই অদ্ভুত মাকড়সা?
একটু ঢুলুনি এসেছিল গৌরের। হঠাৎ দূর থেকে একটা খটখট শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল। চটকা ভেঙে সোজা হয়ে বসল গৌর। ঘোড়ার পায়ের শব্দ না? জোর কদমে নয়, আস্তে আস্তে একটা ঘোড়া হেঁটে আসছে এদিকপানে।