ফকিরসাহেবের মুখোনা দিব্যি হাসি-হাসি ছিল এতক্ষণ। কানের আতর-ভেজানো তুলো থেকে দিব্যি সুবাস আসছিল। তেল-চুচুক করছিল মুখোনা। রাজা রাঘবের নামটা শুনেই কেমন যেন হত্ত্বকির মতো শুকিয়ে গেল। ফকিরসাহেব একটা ঢোক গিলে বললেন, “তোর মা বলল? অ্যাঁ! ওরে বাবা! তা কী বলল বল তো! রাঘব আসছে নাকি?”
“তা আমি জানি না। মা শুধু সাবধান করে দিয়ে গেল। কেন ফকিরবাবা, রাঘবরাজা কি খুব সাংঘাতিক লোক?”
ফকিরসাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে অনেকক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর আপনমনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “ঈশানকোণে রক্তমেঘ! আগেই জানতুম, আর বেশিদিন নয়। লেগে যাবে সুন্দে-উপসুন্দে। গাঁ ছারখার হয়ে যাবে। ওরে বাবা!”
গৌর হাঁ করে ফকিরসাহেবের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল না, ব্যাপারখানা কী।
ফকিরসাহেব বিড়বিড় করা থামিয়ে তার দিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে বললেন, “এখনও বসে আছিস যে বড়! এখনই গিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে মরে যা। কোনও ভয় নেই, মরতে না মরতেই আমি আত্মাটাকে চিমটে দিয়ে ধরে বের করে এনে আরশিতে পুরে ফেলব।”
“মরব ফকিরবাবা? কেন?”
“বেঁচে থেকে আর সুখ কী রে? সে যদি এসেই যায়, তবে বেঁচে থেকে আর সুখ কী? গাঁ কে গাঁ শ্মশান হয়ে যাবে।”
“রাঘব কে ফকিরবাবা?”
“ওরে বাবা, সে আমি জানি না।”
“এই যে এতক্ষণ বিড়বিড় করে কী সব বলছিলেন, যা শুনে মনে হল, রাঘবরাজা খুব খারাপ লোক।”
ফকিরসাহেব নিজের কানে হাতচাপা দিয়ে বললেন, “ভুল বলেছি তা হলে। ও কিছু নয়। তুই বাড়ি যা তো, বাড়ি যা।”
গৌর বেজার মুখে উঠে পড়ল।
৪. দুপুরবেলা ভাত খেয়ে
দুপুরবেলা ভাত খেয়ে গৌর যখন পুকুরে বাসন মাজছে, তখন দেখল, পাশের কচুবনের মধ্যে একটা লোকের মাথা। উবু হয়ে হয়ে কী যেন খুঁজছে। কৌতূহলী হয়ে গৌর উঠে ভাল করে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, “ওখানে কে গো?”
লোকটা মুখ তুলে তার দিকে চেয়ে একটা ধমক দিল। “কাজের সময় কেন যে এত চেঁচামেচি করিস।”
গৌর দেখল, গোবিন্দদা। চাপা গলায় সে বলল, “গোবিন্দদা! ওখানে কী করছ তুমি?”
“করছি তোর মাথা আর মুণ্ডু! কাছে আয়।”
গৌর একটু অবাক হল। তারপর হাত ধুয়ে গুটিগুটি গিয়ে কচুবনে সেঁধোল। দেখল, গোবিন্দ একটা তামার ঘটে জল নিয়ে তার ওপর একখানা সিঁদুরমাখানো ছোট্ট আয়না ধরে চারদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী যেন দেখছে। দেখতে দেখতে বলল, “সন্ধান প্রায় পেয়ে গেছি। পশ্চিম দিকেই ইশারা দিচ্ছে।”
গৌর উদগ্রীব হয়ে বলল, “কবচটা?”
“তবে আর কী খুঁজব রে গাড়ল! ইশ, কাল রাতে কী চোরের মারটাই না খেলি গুড়াদুটোর হাতে!”
“তুমি দেখেছ!”
“চোখের পাতা না ফেলে দেখেছি। প্রথম থেকে শেষ অবধি।”
গৌর অভিমানের গলায় বলল, “তবু আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করোনি? তুমি কেমনধারা ভালবাসো আমায়?”
গোবিন্দ খিঁচিয়ে উঠে বলে, “হ্যাঁ, তোকে বাঁচাতে গিয়ে দু-দুটো গুন্ডার হাতে হাড় ক’খানা ভেঙে আসি আর কী! তা তুইও তো ঘাড়েগদানে কম নোস, নিজেকে বাঁচাতে হাত-পা ছুঁড়তে পারলি না? নিদেন কামড়েও তো দিতে পারতিস!”
গৌর মুখ গোমড়া করে বলে, “সেটা পারলে আর কথা ছিল নাকি! ওরা কুটুম-মানুষ না! কুটুমের গায়ে হাত তোলে কেউ? আর তুললে দাদাই কি আমাকে আস্ত রাখবে?”
গোবিন্দ ভেবেচিন্তে বলল, “তা বটে। তা খেয়েছিস না হয় একটু মারধর। কিল, চড়, ঘুসি, চুলের গোছায় টান, এ-সব এমনিতে খেতে ভাল লাগে না বটে, তবে ওসব খেলে গা-গতর বেশ শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে, গায়ের জোর বাড়ে, মনের জোরও বাড়ে। যে-সব ছেলে মারধর খায় না, তারা একটুতেই দেখবি কাহিল হয়ে পড়ে। তা ছাড়া মারধর খেলে ভয়ডরও চলে যায়। এতে তোর ভালই হচ্ছে।”
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “পেটে খেলে পিঠে সয়– কথাটা তো জানেনা! আমার কপালে পেটে কিছু নেই, কিন্তু পিঠে আছে।”
গোবিন্দ জবাব দিল না, দর্পণে কী যেন ইশারা পেয়ে বনবাদাড় ভেঙে পশ্চিম দিকে ধেয়ে চলল। পিছু পিছু গৌর। দন্তকলসের জঙ্গল, ভাটগাছ আর বিছুটিবন পেরিয়ে একটা ঢিবির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল গোবিন্দ। ঢিবির গায়ে একটা বড়সড় গর্ত। ছুঁচোর বাসাই হবে। সেই গর্তের সামনে দর্পণটা ধরে থেকে গোবিন্দ একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বলল, “হয়েছে।”
“কী হয়েছে গোবিন্দদা?”
“গর্তের মধ্যেই আছে। দৌড়ে গিয়ে একটা শাবল নিয়ে আয়।”
চোখের নিমেষে গৌর দৌড়ে গিয়ে শাবল আনল। গোবিন্দ গর্তটার মুখে শাবল ঢুকিয়ে চাড় দিতেই ঢিবির অনেকটা অংশ ঝুরঝুরে হয়ে ভেঙে পড়ল। গোবিন্দ খানিক মাটি সরিয়ে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিতেই বাচ্চাসমেত তিনটে ধেড়ে ছুঁচো বেরিয়ে কিচিক-মিচিক শব্দ করে দিগবিদিক হারিয়ে ছুটে পালাল। গোবিন্দ বগল পর্যন্ত হাত ঢুকিয়ে খানিকক্ষণ হাতড়ে অবশেষে যখন হাত বের করে আনল, তখন তার হাতের মুঠোয় কবচ।
গৌরের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল। চেঁচিয়ে বলল, “এই তো আমার কবচ!”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “সে তো ঠিকই রে। অসাবধানে রেখেছিলি বলে ছুঁচোয় মুখে করে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু অত আনন্দ করার মতো কিছু হয়নি।”
“কেন গোবিন্দদা, তোমরাই তো বলো, একবচের নাকি সাংঘাতিক গুণ!”
“সেটাও মিথ্যে নয়। তবে যোগেশ্বরবাবার দেওয়া ও কবচ হচ্ছে ঘুমন্ত। ঘুমের মধ্যে কি তুই কাজ করতে পারিস?”