গদাধর সমাদ্দার প্রতিবাদ করে বলল, “না না, হরেনজ্যাঠা, এ আপনি কী বলছেন? গোপালহাটিতে এখনও ভূত গিজগিজ করছে। এই তো সেদিন নীলকুঠিতে সন্ধেবেলা স্বচক্ষে আমি একজোড়া সাহেব-মেমকে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে দেখেছি।”
গোপীনাথ সামন্ত ডন-বৈঠক করে, ছোলা খায়, গুলি ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সে তেজালো গলায় বলে উঠল, “ওসব ভূতফুত কিচ্ছু নয়। আসুক দেখি ভূত আমার সামনে, কেমন বুকের পাটা? ভূতের গুষ্টির তুষ্টি করে ছেড়ে দেব না!”
মৃগেন মিত্তির রোগাভোগা হলেও গলার জোর আছে। হেঁকে বলল, “অত বীরত্ব ফলিয়ো না হে! ভূতের সঙ্গে লড়তে চাও তো একবার আমার শ্বশুরবাড়ি গ্যাদরাপোতা থেকে ঘুরে এসো, বীরত্ব চুপসে যাবে। সেখানে চালে ভূত, ডালে ভূত, জলে ভূত, গাছে ভূত, ছাদে ভূত, একেবারে ভূতে ভূতাক্কার। আমার শাশুড়ি তো সেদিন কাঁচকলা ভেবে একটা ভূতকেই ভাতে সেদ্ধ দিয়েছিলেন। গরমভাত থেকে তুলে ছাল ছাড়াতে যাবেন, অমনি কাঁচকলাটা লাফ দিয়ে উঠে ফের গিয়ে গাছে ঝুলে পড়ল। ভূত-সেদ্ধ হওয়া ভাত তো আর খাওয়া যায় না। একহাঁড়ি ভাত ফেলা গেল!”
দোলগোবিন্দ প্রামাণিক খুব হুশিয়ার মানুষ বলে সবাই জানে। কখনও কারও নাম ভুল হয় না। জন্মে সে কোনও দিন পয়সা, চশমা, কলম, চটি, আংটি বা ঘড়ি হারায়নি। বাজার থেকে সতেরোটা জিনিস আনতে দেওয়া হলে কখনও ষোলোটা আনেনি। সেই দোলগোবিন্দ খুব চিন্তিত মুখে বলল, “ভৌতিক কাণ্ড যে একটা হচ্ছে সেটা আমারও মনে হয়। সবাই জানে যে, আমার বড় একটা ভুল-টুল হয় না। তা গতকাল বুকপকেটে বাহান্ন টাকা নিয়ে বাজারে গিয়েছি। দাম দিতে গিয়ে দেখি, টাকাটা নেই। সাবধানের মার নেই বলে আমি বুকপকেটে সেফটিপিন দিয়ে টাকা আটকে রাখি, যাতে পকেটমার না হয়। আশ্চর্যের বিষয় হল, সেফটিপিন যেমন ছিল তেমনই আছে, কিন্তু টাকাটা হাওয়া। আমার জীবনে এমন কাণ্ড এই প্রথম। হাঁ করে আকাশ-পাতাল ভাবছি, হঠাৎ প্যান্টের বাঁ পকেটে হাত দিয়ে দেখি, সেই বাহান্ন টাকা আমার বাঁ পকেটে ঢুকে বসে আছে। ভৌতিক কাণ্ড ছাড়া একে আর কী বলা যায় বলো তো?”
বৃন্দাবন কর্মকার বলে উঠল, “ওহে, ওরকম কাণ্ড তো আমার পরপর দু’দিন হল। আমার ডান দিকের ট্র্যাকে নস্যির ডিবে থাকে, বহুঁকালের অভ্যেস। দু’দিন হল দেখছি, ডিবেটা যতই ডান ট্র্যাকে খুঁজি না কেন, সেটা ঠিক আমার বাঁ ট্র্যাকে চলে আসছে। ভূতটুত আমি বিশ্বাস করি না বটে, কিন্তু কাণ্ডটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝেও উঠতে পারছি না।”
অনাদি মিত্তির বললেন, “তোমাদের কথায় মনে পড়ল, আমার বাড়িতেও কিন্তু অশৈলী কাণ্ড হয়েছে। গত দু’দিন হল দেখছি, দরজা এঁটে রাতে আমরা শুতে যাই, কিন্তু সকালে উঠে দেখি, খিল, ছিটকিনি সব খোলা। ঘরের জিনিসপত্র কিছু খোয়া যায়নি ঠিকই, কিন্তু জিনিসপত্র কে যেন উলটে-পালটে রেখে গিয়েছে। যেমন আলমারির মাথায় রাখা চামড়ার সুটকেসখানা কে যেন দরদালানে আলনার নীচের তাকে রেখে গিয়েছে। টেবিলঘড়িখানা রেখে গিয়েছে ঠাকুরঘরে। রোজ সকালে গীতা পাঠ করি বলে সেখানা আমার শিয়রে একটা টুলের উপর থাকে। তা দেখি, কে যেন গীতাখানা বইয়ের তাকে তুলে রেখে তার বদলে ‘সচিত্র গোপালভাঁড়’ বইখানা শিয়রে রেখে গিয়েছে।”
বিধুভূষণ চাকি মাথা চুলকে বললেন, “এসব আসলে মনের ভুল ছাড়া কিছু নয়। দু’দিন হল দেখছি, আমার ড্রয়ারে রাখা চাবি বালিশের তলায় পাওয়া যাচ্ছে। আমার গিন্নির দোক্তার কৌটো গিয়ে সবজির ঝুড়িতে ঘাপটি মেরে আছে। তা বলে কি আর এসব ভুতুড়ে ব্যাপার!”
বিজয়বাবু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে এসব কথা শুনছিলেন। কিন্তু তাঁর মাথায় কিছুই সেঁধোচ্ছিল না। মগজটা বড্ড ভোম্বল হয়ে আছে আজ।
দুপুরবেলা যখন ঘরখানা নিরিবিলি হল, তখন খুব ভয়ে-ভয়ে অনেক দোনোমোনো করে তাঁর বইয়ের তাক থেকে ভূত বিষয়ক বইগুলো খুঁজেপেতে বের করলেন। বুকটা একটু ধুকপুক করছে বটে, তবু চারদিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে বই খুলে বসে গেলেন। তিনি হলেন জাতপড়ুয়া। একবার বই খুলে ফেললেই তিনি তাতে ডুবে যান, আর বাহ্যজ্ঞান থাকে না। যখন বেলা পড়ে বাইরের আলো মরে এল, তখন চোখ তুলে বাইরেটা দেখলেন জানালা দিয়ে। তাই তো, সন্ধে যে হয়-হয়! আলো জ্বালাবার জন্য যেই উঠতে যাচ্ছেন, অমনি আঁতকে উঠে দেখলেন, তাঁর সামনেই মেঝের উপর খাপ পেতে উবু হয়ে বসে একটা আধবুড়ো লোক তাঁকে জুলজুল করে দেখছে। কাঁচাপাকা চুল, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। তাঁর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা এমন উত্তেজিত হয়ে উঠল যে, ইস্তফা দেয় আর কী! তিনি প্রথমটায় বাক্যহারা, তারপর কোঁক করে একটা শব্দ বেরোল, তারপর ক্ষীণ গলায় বলে উঠলেন, “ভূ-ভূত! ভূ-ভূত! ভূ-ত! আঁ-আঁ-আঁ…!”
লোকটা টপ করে উঠে এসে দুটো শক্ত হাতে তাঁকে ধরে বসিয়ে দিয়ে ভারী অমায়িক গলায় বলল, “আজ্ঞে, আমি ঠিক ভূত নই।”
কথাটা শুনে লোকটাকে ভারী ভাল লোক বলে মনে হল বিজয়বাবুর। যারা ভূত নয় তাদের মতো ভাল আর কে আছে? তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললেন, “ভূত নন?”
লোকটা যেন একটু চিন্তায় পড়ে গেল। মাথাটাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, ভূত হতে বেশি বাকিও নেই। তিনকুড়ি বয়স তো আর ছেলে-ছোঁকরার বয়স নয়। তবে ভূত হতে গেলে মরারও একটা নিয়ম আছে কিনা! তা সেটা আমার এখনও হয়ে ওঠেনি।”