বিজয়বাবু অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর সামনে হাতজোড় করে একজন বুড়ো মানুষ দাঁড়িয়ে।
বিজয়বাবুদের বিরাট পরিবার, বাড়িটাও বিশাল বড়। আত্মীয়স্বজনে ভর্তি। তা ছাড়া কাজের লোকও মেলা। সবাইকে বিজয়বাবু চেনেনও না।
বললেন, “কী চাই?”
“আজ্ঞে, আমাকে সুধীরবাবু পাঠালেন। উনি একটু মিটিং নিয়ে ব্যস্ত বলে নিজে আসতে পারলেন না। তাই আমাকেই পাঠিয়েছেন কথাটা বলতে।”
বিজয়বাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “সুধীরবাবু! সুধীরবাবুটা আবার কে?”
লোকটা শশব্যস্তে বলল, “আজ্ঞে, ন’পাড়ার সুধীরবাবুর কথাই বলছি। সুধীর ঘোষ।”
বিজয়বাবু অবাক হয়ে বললেন, “সুধীর ঘোষ! তা কী করে হয়? গত বিস্তার না শুক্রবার, কবে যেন তার শ্রাদ্ধের ভোজ খেয়ে এলাম যে?”
লোকটা হাত কচলে ভারী আহ্লাদের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে, তা ভোজটা কেমন ছিল বাবু?”
বিজয়বাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “তা ভালই তো ছিল। লুচি, বেগুনভাজা, মোচার চপ, ধোঁকার ডালনা, ছানা ভাপে, ছোলার ডাল, চাপড়ঘণ্ট, ফুলকপির রোস্ট, আমসত্ত্বের চাটনি, দই, সন্দেশ, রসগোল্লা, রসমালাই। হ্যাঁ, তা বেশ ভালই খাইয়েছিল। যার শ্রাদ্ধ হয়ে গিয়েছে, সেই লোক তোমাকে পাঠায় কী করে?”
লোকটা হেঁ হেঁ করে একটু হেসে বলল, “আজ্ঞে, সেটাই তো সমস্যা। এই সমস্যার একটা বিহিত যে আপনাকে করে দিতেই হবে!”
“তুমি কি বলতে চাও যে, সুধীর ঘোষ আদৌ মারা যাননি? তা হলে কি মারা যাওয়ার আগেই তার ছেলেরা আগাম শ্রাদ্ধ করে রাখল? কিন্তু তাই বা হয় কী করে? সেরকম তো নিয়ম নয়! লোকে নিজের আগাম শ্রাদ্ধ করে রাখতে পারে বটে, কিন্তু ছেলেরা কি তা পারে?”
লোকটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “না বাবু না, তিনি নির্যস মরেছেন। সুধীর ঘোষ মোটেই বেঁচে নেই। আবার মরেও বেঁচে আছেন, আর এইটেই সমস্যা। এই আমি যেমন। গত বছর বোশেখ মাসে সান্নিপাতিকে মরেছি। কিন্তু দেখুন, এখনও কেমন টিকে আছি!”
বিজয়বাবু আঁতকে উঠে বললেন, “মরেছ মানে? মরেছ বললেই হবে?”
লোকটা করুণ গলায় বলল, “ওই তো আপনাদের দোষ! পণ্ডিত মানুষরা সহজে কিছু বিশ্বাস করতে চান না। ঠিক আছে, তা হলে নিজের চোখেই দেখুন, বেঁচে আছি কি না।”
বলেই লোকটা বিজয়বাবু চোখের সামনেই ফুস করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বিজয়বাবু হাঁ। তারপর তার চোখের সামনেই যেন একটা অদৃশ্য দরজা খুলে গ্যালগ্যালে হাসিমুখে বেরিয়ে এসে লোকটা হাতজোড় করে বলল, “দেখলেন তো?”
বিজয়বাবু হাতের বইটা পাশের টেবিলে রেখে খুব চিন্তিত মুখে বললেন, “তাই তো! এ তো খুব মুশকিলে ফেলে দিলে দেখছি। কয়েকদিন আগে আমাদের লখাইও এরকম কী একটা বলতে এসেছিল।”
“তা বাবু এবার একটু বইপত্তর ঘেঁটে দেখবেন নাকি, আমাদের কথা কিছু লেখা আছে কি না?”
“দেখছি। ভূতের উপরেও কিছু বই আমার আছে বটে! সেগুলো ভাল করে পড়া হয়নি। এবার পড়তেই হবে।”
লোকটা তাঁকে একটা নমো ঠুকে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার পর বিজয়বাবু কিছুক্ষণ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। তারপর হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল, আমি কি সত্যিই ভূত দেখলাম? আঁ, ভূত দেখলাম নাকি আমি? ওরে বাবা! আমি যে ভূত দেখে ফেললাম! বলতে বলতেই তাঁর নোম খাড়া হয়ে উঠল। মাথার চুল সব শজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে যেতে লাগল। শরীর ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। গলা দিয়ে স্বর ফুটতে চাইছিল না। তবু প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়ে তিনি বিকট গলায় চেঁচাতে লাগলেন, “ভূত! ভূত! ভূ-উ-ত! ভূ…!”
ওই বিকট চেঁচানিতে ঘুম ভেঙে বাড়ির লোকজন সব ছুটে এল। হাতপাখা এল, জল এল, মহা শোরগোল পড়ে গেল চারদিকে।
পরদিন সকালেও নিজের ডেকচেয়ারটিতে কাহিল হয়ে এলিয়ে বসে বিজয়বাবু আপনমনে বিড়বিড় করে যাচ্ছিলেন, “আমি কি ভূত দেখে ফেললাম নাকি রে বাবা? ওরে বাবা, আমি যে ভূত দেখে ফেললাম! আঁ, সত্যিই কি দেখে ফেললাম নাকি? বাপ রে! তবে কি দেখেই ফেললাম? অ্যাঁ?”
হাড়কিপটে নীলমণি ঘোষ এসে বললেন, “আহা, দেখেই যখন ফেলেছ তখন তো ল্যাটা চুকেই গিয়েছে। এ হল শীতকালে জলে ডুব দেওয়ার মতো। প্রথম ডুবটা দিয়ে ফেললেই হল, তারপর যত খুশি ডুব দাও। একবার ভূত দেখে ফেললে তো আড় ভেঙেই গেল হে! আর ভয়টা কীসের?”
বিজয়বাবু এতই আনমনা যে, প্রথমটায় নীলমণি ঘোষকে চিনতেই পারলেন না। শুধু বললেন, “ওরে বাবা রে, আমি যে ভূত দেখেছি! দেখেই ফেলেছি! একেবারে স্বচক্ষে দেখে ফেললাম যে!”
স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক বিধুভূষণ চাকি এসে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বললেন, “ভূত দেখেছেন মানে? ভূত অমনি
দেখলেই হল? এর পর তো লোকে সাপের পা, ডুমুরের ফুল এসবও দেখতে পাবে? না না, বিজয়বাবু, আপনাকে আমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক, শিক্ষিত, যুক্তিবাদী লোক বলে জানতাম। শেষ অবধি আপনিও যদি ওসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তা হলে তো দেশ উচ্ছন্নে যাবে?”
শুটকো অনাদি মিত্তির খ্যাক করে উঠে বললেন, “বেশি ফ্যাচফ্যাচ কোরো না তো বিধু! বিলেতের একটা ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা নিয়মিত ভূত দেখতে পায়। আর সেটা একজন বৈজ্ঞানিকেরই ভূত।”
“এ খবর আমিও পড়েছি। তারা ভুল দেখেছে।” হরেন কাঁড়ার বুড়োমানুষ। দাড়ি নেড়ে বললেন, “গোপালহাটির দুটো জিনিস খুব বিখ্যাত। একটা হল, ষষ্ঠী ময়রার মাখাসন্দেশ, আর হল, এখানকার ভূত! আগে তো সাহেবসুবোরাও জুড়িগাড়ি চেপে গোপালহাটির ভূত দেখতে আসত। সন্ধের পর ভূতেরাও সব সেজেগুঁজে বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু সেই দিনকাল কি আর আছে? ষষ্ঠী ময়রার মাখাসন্দেশেও আর সেই সোয়াদ নেই, ভূতেরাও সব গায়েব। তা বিজয়ভায়ার ভাগ্য ভাল যে, অন্তত একখানা ভূতের দেখা পেয়েছে। তাতে গোপালহাটির মানটা অন্তত বাঁচল!”