“লখাই। তোমার?”
“আমি হলুম বগা।”
“এই খালধারেই তোমার বাড়ি বুঝি?”
“আরে না! একশো বছর আগে গোঁসাইপাড়ায় আমাদের দু’খানা কুঁড়েঘর ছিল বটে, সেসব আর নেই। ওই যে বললুম, এই খালে রোজ বিকেলে আমিও মাছ ধরতুম। তারপর দিল একদিন মা মনসার বাহন ঠুকে। কেউটে!”
“আহা রে!”
“মরে গিয়ে দুঃখ আমারও হয়েছিল। তখন আমার কতই বা বয়স? এই তোমার মতোই হবে। বড়জোর কুড়ি-বাইশ। রাগের চোটে আমি সাপটার উপর চড়াও হলুম। তার গর্তে গিয়ে ঢুকে গলা চেপে ধরে বললাম, “ল্যাজে একটু পা পড়েছে বলেই কামড়াবি হতচ্ছাড়া? আমার খালুইভরা মাছ পড়ে রইল। তাঁকে বারো গন্ডা পয়সা পড়ে রইল, আমার বুড়ি মা হাঁ করে দাওয়ায় বসে রইল, কোন আক্কেলে বিষ ঢাললি রে বদমাশ?’ তা দেখলুম, সাপটা বাংলা কথা একদম বুঝতে পারল না। শুধু ফেসফাস করতে লাগল। বিশেষ পাত্তা দিল না।”
সেবার বর্ষার সময় খাল-বিল একাকার হওয়ায় বড় গাং থেকে খালে কামট ঢুকে পড়েছিল। লখাই তখন কোমরজলে নেমে মাছ ধরছে, ঠিক সেই সময় পিছন থেকে “লখাই, কামট! কামট! উঠে আয়।” বলে বগা চেঁচিয়ে হুঁশিয়ার করে দেওয়ায় অল্পের জন্য |||||||||| বেঁচে যায় লখাই। নইলে কামটটা তার পেটের মাংস প্রায় খুবলেই নিয়েছিল আর কী! তো তার পর থেকে বগার সঙ্গে তার দিব্যি ভাবসাব হয়ে যায়। মাঝে-মাঝে পাশাপাশি বসে দু’জনে সুখ দুঃখের কথাও কয়।
একদিন খুব চিন্তিতভাবে লখাই বলল, “আচ্ছা বগাদা, তোমার তো মোটে শরীরই নেই, তা হলে আছো কী করে?”
বগাও ভারী ভাবনায় পড়ে গিয়ে বলল, “সে কথাটা নিয়ে আমিও অনেক ভেবেছি, বুঝলি! কিন্তু ভেবে থই করে উঠতে পারিনি।”
“আচ্ছা, তোমার কি খিদে পায়?”
“না তো!”
“অসুখবিসুখ করে?”
“না।”
“ভীমরুলে হুল দিলে ব্যথা পাও?”
“উঁহু।”
“তা সেটা তো ভাল কথা। কিন্তু কী করে বর্তে আছো সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।”
“হু। হাওয়া-বাতাসের মতো একটা মিহিন জিনিস হয়ে গিয়েছি বলে মনে হয়।”
“কিন্তু সেখানেও কথা আছে। হাওয়া-বাতাস তো আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তোমাকে তো দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। তুমি ঢ্যাঙা, রোগা গড়ন, লম্বাটে মুখ, মাথায় ছোট-ছোট চুল। এমনকী, পরনে ধুতি আর গায়ে ফতুয়া পর্যন্ত আছে। একটু আবছা-আবছা বটে, কিন্তু দেখা তো যাচ্ছে!”
“কথাটা মন্দ বলিসনি। না থেকেও আছি কী করে, সেটা আমিও ঠিক বুঝতে পারি না। তুই বরং বিজয়বাবুকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখিস। তার মেলা বিদ্যে। দিনরাত রাশিরাশি কেতাবের মধ্যে ডুবে আছে। দেখবি, ঠিক ফস করে বলে দেবে।”
“ঠিক বলেছ তো! কথাটা আগে কেন মাথায় খেলেনি সেটাই ভাবছি।”
৩. বিজয় রায়ের বাড়িতে
তা বিজয় রায়ের বাড়িতে লখাইয়ের অবারিত দ্বার, খালুইভর্তি মাছ রোজ সে রায়বাড়িতেই বিক্রি করে পয়সা তাঁকে খুঁজে বাড়ি ফেরে। তাই সে একদিন বিজয়বাবুকে গিয়ে ধরল।
বিজয়বাবুর ঘরখানা দেখলে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। ঘরের চারখানা দেওয়াল যেন ইট গেঁথে তৈরি হয়নি, হয়েছে বই গেঁথে। মেঝে থেকে ছাদ অবধি তাক-ভর্তি শুধু বই আর বই। টেবিলে বই, চেয়ারে বই, বিছানায় বই, মেঝেতেও স্থূপ হয়ে পড়ে আছে বই। শোনা যায়, বিজয়বাবুর স্নানের ঘরেও নাকি মেলা বই। বিজয়বাবুকে বই ছাড়া কমই দেখা যায়। সর্বদাই চোখে ভারী চশমা এঁটে নাকের সামনে বই মেলে ধরে পড়ে যাচ্ছেন তো পড়েই যাচ্ছেন।
লখাই ঘরে ঢুকে জুত করে বিজয়বাবুর পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়ে বলল, “বাবু, একটা কথা আছে।”
বিজয়বাবু চোখের সামনে থেকে বইখানা ঈষৎ সরিয়ে বললেন, “লখাই নাকি রে? কী দরকার?”
“আজ্ঞে, একটা সমিস্যেয় পড়ে আসা।”
“কীসের সমস্যা?”
“সমিস্যেটা ভূত নিয়ে।”
“অ। তা আমার কাছে কেন রে? পীতাম্বর ওঝার কাছে গেলেই তো হয়। না হলে বিভূতি ডাক্তারকে ডেকে মৃগীর চিকিৎসা করা।”
“আজ্ঞে, কাউকে ভূতে ধরেনি আজ্ঞে।”
“ধরেনি? তা হলে সমস্যা কীসের?”
“ভূত জিনিসটা কী দিয়ে তৈরি আর মরার পরও তারা বেঁচে থাকেন কী করে, এ দুটো জিনিস একটু বলে দিলে ভাল হয়।”
বিজয়বাবু অট্টহাসিটা ভালই হাসেন। অনেকটা ঔরঙ্গজেবের মতো। যাত্রাপালাটা দেখেছে লখাই। হেসে নিয়ে বিজয়বাবু বললেন, “শোন, ভূত বলে কিছুই নেই, আর মরার পর তারা কেউ বেঁচেও নেই, বুঝলি! এখন যা, মাথায় ঠান্ডা জল চাপড়ে ভাত খেয়ে গিয়ে ঘুমো৷”
লখাই শশব্যস্তে বলল, “আজ্ঞে, না মশাই, বগাদার সঙ্গে যে প্রায়ই আমার দেখা হয়, কথাবার্তাও হয়।”
“বগাটা আবার কে?”
“বগা সামন্ত, আজ্ঞে। একশো বছর আগে সাপকাটিতে মারা গিয়েছিল। তা তিনিই কথাটা জানতে চেয়েছেন।”
বিজয়বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “তা ভূত যদি আমার কাছে এসে জানতে চায়, তা হলে না হয় দেখা যাবে। এখন যা তো, বিরক্ত করিস না।”
লখাই মনখারাপ করে ফিরে এল। পরদিন বগাকে বলল, “না বগাদা, উনি মোটে মাথাই পাতলেন না। ভূতকে ভারী তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন বলেই মনে হল।”
বগাও হতাশ হয়ে বলল, “তা কী আর করবি? আমাদের কপালই খারাপ।”
তিন-চারদিন পর অবশ্য বিজয়বাবুকে একটু নড়েচড়ে বসতে হল।
রাত তখন বারোটা বেজে গিয়েছে। বিজয়বাবু বসে একমনে একখানা বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়ছেন। বাহ্যজ্ঞান নেই।
ঠিক এই সময় কে যেন খুব বিনয়ের সঙ্গে একটু গলাখাঁকারি দিয়ে ডাকল, “বাবু, একটু নিবেদন ছিল, আজ্ঞে!”