একটু নাক সিটকে গুরুপদ বলল, “তা আপনাকে তেমন ভক্তিছেদ্দা হচ্ছে না বটে, তবে মানতে হবে যে, আপনার এলেম আছে। টাকাটা এমন মোলায়েম হাতে তুলে নিয়েছিলেন যে, টেরটাও পাইনি। কিন্তু কথাটা হল, টাকাটা ফের ফেরত দিলেন কেন?”
বটু সর্দার উদাস মুখ করে বলল, “টাকা দিয়ে আমার হবেটা কী? আমারটা খাবে কে? তিনকুলে কেউ নেই, চেলাচামুণ্ডা যারা ছিল তারাও লায়েক হয়ে যে যার ধান্দায় নেমে পড়েছে।”
গুরুপদ তাজ্জব হয়ে বলল, “তবে পকেট মারলেন কেন?”
“অভ্যেস রাখতে হয়, অভ্যেস রাখতে হয়। নইলে যে আঙুলে মরচে পড়ে যাবে।”
গুরুপদ একটু দোনোমোনো করে বলল, “পকেটমারিটা আমারও একটু শেখার ইচ্ছে ছিল মশাই! না হয় আপনার কাছেই শিখতাম!”
বটু সর্দার বিরস মুখে ঘনঘন মাথা নাড়া দিয়ে বলল, “সে উপায় নেই হে। আমার ডঙ্কা বেজে গিয়েছে।”
“তার মানে?”
“আজ, কাল বা পরশুর মধ্যেই আমার খুন হয়ে যাওয়ার কথা। দু’-একদিন এদিক-ওদিক হতে পারে।”
“সে কী! কে খুন করবে আপনাকে?”
“সেইটেই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছি না। দু’-দু’বার তাদের তাক ফসকেছে। তিনবারের বার বড় একটা ফসকায় না।”
উৎকণ্ঠিত গুরুপদ বলল, “তা আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন না কেন?”
“পালানোও কি চাট্টিখানি কথা? মাথা গোঁজার জায়গা দেবে কে? আর দিলেও কি রেহাই আছে বাপু? তারা ঠিক খুঁজে বের করবে।”
“তা হলে পুলিশের কাছে যান।”
বটু সর্দার করুণ একটু হেসে বলল, “তারাও ফঁসিতে ঝোলাবে বলে ওত পেতে আছে যে! জেলখানায় মরা আমার তেমন পছন্দ নয় বাপু। তার চেয়ে মাঠেঘাটে মরা অনেক ভাল। মরতে মরতেও হয়তো আকাশ-টাকাশ দেখা যাবে, একটু পাখির ডাকও কানে আসবে। চাই কি একটু ফুরফুরে বাতাসও এসে লাগবে গায়ে। কী বলো?”
“না না, ওটা কোনও কাজের কথা নয়। আপনি লোকটা হয়তো তেমন ভাল নন। কিন্তু গুণী লোক তো! এরকম বেঘোরে মরতে দেওয়া যায় না। চলুন, আমাদের বাড়িতে চলুন। আমাদের বাড়িতে মেলা লোক। সেখানে ভয় নেই।”
“পাগল নাকি! আমাকে নিয়ে শেষে বিপদে পড়বে বাপু।”
“হোক বিপদ। আমি ছাড়ছি না আপনাকে।”
২. কখনও ছাঁকনি জাল
কখনও ছাঁকনি জাল, কখনও ফাঁদি জালে রোজ এই সন্ধেবেলাটায় খালে মাছ ধরে লখাই। বেশিরভাগই চুনোপুঁটি। খালুই মাঝামাঝি ভরে গেলেই উঠে আসে। গোপালহাটির কুমোরপাড়ার খালধার বড় ভাল জায়গা নয়। কাছেপিঠে লোকবসতি নেই। চারদিক বড় বড় গাছের ছায়ায় হাকুচ অন্ধকার। বুক সমান আগাছায় চারদিক ছেয়ে আছে। তবে ভয় খেলে তো গরিবের চলে না।
আজ একটু দেরিই হয়ে গেল লখাইয়ের। অন্ধকারটা বেশ গাঢ়িয়ে গিয়েছে। শেষ দিকটায় একটা মাছের ঝাক চলে আসায় লখাই উঠে আসতে পারছিল না। খালুই আজ প্রায় ভরাভর্তি। লখাই ভারী খুশি। আজ যাহোক দুটো পয়সা আসবে হাতে।
তা এই খালধারে যাতায়াতের পথে লখাইয়ের সঙ্গে অনেকেরই দেখা হয়। শিয়াল, সাপ, বেজি, ভাম, বাদুড়। একদিন তেনাদের একজনের সঙ্গেও দেখা হয়ে গিয়েছিল। তেড়ে ঝড়জল হচ্ছিল সেদিন। আকাশও ঘনঘন ঝিলিক মারছিল। ওই অশ্বথ গাছটার তলায় একটা ঝিলিকের আলোয় দেখল, লম্বামতো কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। দু’খানা ভীমলোচনে যেন লখাইয়ের দিকেই চেয়ে। ভয়ে রামনামটা অবধি ভুলে মেরে দিয়েছিল সেদিন। হাত-পায়ে সাড় ছিল না। চিড়বিড় করে কেবল বলছিল, “আরে, ওই যে কার যেন ছেলে, কী যেন নাম? আরে ওই তো বনবাসে গিয়েছিল যে লোকটা? ধুত্তোর, ওই যে হরধনু ভাঙল না! কী মুশকিল! নামটা যে পেটে আসছে, মুখে আসতে চাইছে না… দ্যাখো তো কাণ্ড…!”
একটু দূর থেকে একটা মোলায়েম খোনা গলা বলে উঠল, “আহা, রামনামের কথা ভাবছ তো? তা রামনাম তো ভাল জিনিস। কষে রামনাম করো তো হে, একটু শুনি।”
লখাই মহা ফঁপড়ে পড়ে গেল। ভূত যদি নিজেই রামনাম করে, তা হলে তো বড়ই মুশকিল! কাজকারবার চলবে কী করে? আতঙ্কে রামনাম ভুলে লখাই আঁ আঁ করে প্রাণপণে আর্তনাদ করে উঠেছিল। লম্বা ভূতটা তখন “আ মোলো যা, এ যে মুছে যায়!” বলে ভারী বিরক্ত হয়ে ফুস করে বাতাসে আর অন্ধকারে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দিনসাতেক পরের কথা! সন্ধের মুখে মাছটাছ ধরে লখাই খাল থেকে ভেজা গায়ে উঠে সবে গুটিগুটি বাড়ির পথ ধরেছে, ফের সেই অশ্বত্থ গাছের তলায় ঝুঝকো আঁধারে সেই লম্বা ভূতকে দাঁড়ানো দেখতে পেল। লখাই “ওরে বাবা রে! ভূত…ভূত…!” বলে চেঁচিয়ে ছুটতে গিয়ে গাছের শিকড়ে পা আটকে পড়ে কুমড়ো গড়াগড়ি। হাঁচোড় পাঁচোড় করে উঠতে গিয়ে সে ‘হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ করে রক্ত জল করা ভুতুড়ে হাসিটাও শুনতে পেল। লখাই ভেবে নিল, আজ আর রক্ষে নেই! সে হার্ট ফেল হয়ে মরেই যাবে বুঝি! হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। দম নিতে আঁকুপাঁকু করছিল সে। হাওয়ায় একটা লাট খেয়ে লম্বা ভূতটা শূন্যে একটু ঝুলে থেকে বলল, “ওরে, এখানে আমিও এককালে মাছ ধরতাম কিনা!”
তবে ভেবে দেখলে ভয় পাওয়ারও একটা শেষ আছে। প্রায়ই ভয় খাওয়ার ব্যাপার হতে থাকলে ভয়টাও ক্ষয় হতে থাকে। কারণ, মাঝেমধ্যেই লম্বা ভূতটা হানা দিতে থাকায় লখাইয়ের ভয়টা ঘষা খেতে-খেতে একেবারে এইটুকুন হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে ঢ্যাঙা ভূতের সঙ্গে তার একটু-আধটু কথা চালাচালিও শুরু হয়। এই যেমন ঢ্যাঙাভূত একদিন জিজ্ঞেস করল, “তোর নাম কী রে?”