লোকটা মিনমিন করে বলল, “আহা, অত ভেবেচিন্তে কি কাজ করা যায়? আমার বাপু মাথাটা আজকাল তেমন খেলে না। হঠাৎ তোমাকে ওই লোকটার সঙ্গে দেখে মনে হল, ওখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা তোমার ঠিক হচ্ছে না। তাই একটু টানা-হাচড়া করতে হল বাপু। কিছু মনে কোরো না।”
“তা হঠাৎ ওরকম কাণ্ড করার ইচ্ছে হল কেন আপনার? পাগল নাকি আপনি?”
লোকটা মাথা চুলকে ভারী ভাবিত হয়ে বলল, “তা আছি বোধ হয় একটু।”
“ওই লোকটাকে কি আপনি চেনেন?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “না হে বাপু, আজকাল চোখেই কি তেমন দেখি? তিন কুড়ি বয়স পুরতে চলল যে! এখন সব কিছু তেমন ঠিকঠাক ঠাহর হয় না, বুঝলে! তবে আবছা যেন মননা মান্না বলে মনে হচ্ছিল। না-ও হতে পারে। একরকম দেখতে দুটো লোকও তো হয়! আকছারই হচ্ছে।”
“আপনি ঠিকই দেখেছেন। লোকটা মনোময় মান্নাই বটে! তা লোকটা কেমন? পাজি লোক নাকি?”
“ওই দ্যাখো! তাই কি বললুম?”
“মানেটা তো সেরকমই দাঁড়াচ্ছে।”
“ওরে না না, পাজি লোক হতে যারে কোন দুঃখে? সত্যি কথা বলতে কী বাপু, আজকাল আর আমি একটাও পাজি লোক দেখতে পাই না। আগে দু-চারটে চোখে পড়ত বটে। কিন্তু এখন আর তাদের তেমন দেখছি না তো! আচ্ছা, পাজি লোকগুলো সব গেল কোথায় বলতে পারো?”
“পাজি লোকের অভাব কী? চারদিকে তারাই তো গিজগিজ করছে! এই যে আপনি, তা আপনিই কী আর ভাল লোক? নড়া ধরে এমন হ্যাঁচকা টান মেরেছিলেন যে, বগল অবধি টাটাচ্ছে।”
লোকটা তেমনি জুলজুলে ভিতু চোখে চেয়ে আমতা আমতা করে বলল, “তা অবিশ্যি ঠিক। আমি তেমন সুবিধের লোক নইও।”
“পাজি লোকের কথা আরও শুনবেন? এই একটু আগেই এই হাটে গামছা দর করার সময় আমার বত্রিশটা টাকা দিনে-দুপুরে
পকেটমার হয়েছে। তবু বলবেন দুনিয়ায় পাজি লোক নেই?”
লোকটা চোখ কপালে তুলে বলল, “পকেটমার হয়েছে? বলো কী? এ তো সব্বোনেশে কথা!”
“আর সেই পকেটমার নাকি বটু সর্দারের লোক। আর বটু সর্দারের আখড়ায় নাকি ডজন-ডজন চোর, ডাকাত, পকেটমার, ছিনতাই আর তোলাবাজ তৈরি হচ্ছে। তবু পাজি লোক চোখে পড়ছে না আপনার?”
লোকটা ভারী আতান্তরে পড়ে চোখ মিটমিট করে বলল, “ওই তো বললাম, আমার চোখ দুটোই গিয়েছে। আজকাল আর ভালমন্দ তেমন ঠাহর পাই না। তবে বাপু, সত্যিকথা বলতে কী, মন্দ যেমন আছে তেমনি ভালও কি আর নেই? যেমন ধরো, পকেটমার হয়তো কারও টাকা পকেট মারল, আবার তারপর হয়তো সেই টাকা ফেরতও দিয়ে দিল। এমন কি আর হয় না? হতেই পারে। ঠিক কিনা বলো?”
“খুব ঠিক! কিন্তু সেকথা আপনি জানলেন কী করে? পকেটমার যে আমার টাকা ফেরত দিয়েছে, সেকথা তো পকেটমার ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়!”
লোকটা বড় বড় চোখে চেয়ে ভারী অবাক হয়ে বলল, “ফেরত দিয়েছে? বলো কী হে? তা হলে কি সত্যযুগ এসে পড়ল নাকি?”
“আপনি কিন্তু কথা ঘোরাচ্ছেন।”
লোকটা সবেগে মাথা নাড়া দিয়ে বলল, “ওরে না রে বাবা, না। মেরেকেটে দশ-বারোটা বাকি সম্বল করে এই তিনকুড়ি বয়স পার করলুম। কথাই জানি না মোটে, তা তার আবার ঘোরপ্যাঁচ। পেটে বিদ্যে থাকলে তো কথার মারপ্যাঁচ শিখব রে বাপু! ওই লেখাপড়া জানা বাবুরা কথা দিয়ে বাঘ-সিংগি মারে, আমাদের কি সে জোর আছে?”
“বুঝলুম! আপনি আর ভেঙে বলবেন না তো? তা হলে আমাকেই বলতে হচ্ছে। আমার পকেট কে মেরেছিল জানেন? সে হল…!”
“ওরে চুপ! চুপ! অমন হেঁকে কি ওসব কথা কইতে আছে? মনো মান্না দলবল নিয়ে ঘুরছে যে! কথাটা কানে গেলেই ফস করে
এসে হাতে হাতকড়া পরিয়ে থানায় টেনে নিয়ে যাবে।”
গুরুপদ অবাক হয়ে বলল, “মনোময় মান্না কি পুলিশের লোক নাকি মশাই?”
লোকটা মাথা চুলকে বলল, “সেরকমই তো শুনি। শোনার ভুলও হতে পারে।”
“বুঝেছি।” লোকটা ফের জুলজুল করে তার দিকে চেয়ে বলল, “তাই বলছিলুম বাপু, টাকাটা যখন ফেরত পেয়েই গিয়েছ, তখন আর দেরি না করে বাড়িমুখো রওনা হয়ে পড়ো। বেলাও পড়ে এল। সন্ধের পর আমি আবার পথঘাট মোটেই ঠাহর করতে পারি না। মগরাহাটি তো আর চাট্টিখানি পথ নয়!”
“মগরাহাটি? আপনি কি মগরাহাটির লোক?”
“তিনকুড়ি বছর ধরে তাই তো জেনে আসছি!”
“তা হলে তো বটু সর্দারকে নিশ্চয়ই চেনেন? তার আখড়া যে ওখানেই?”
“হতে পারে! মগরাহাটি বিরাট জায়গা, মেলা লোকের বাস। আমি কি আর সবাইকে চিনে বসে আছি নাকি?”
“শুনেছি, সেখানে তার বিরাট আখড়া! গন্ডায়-গন্ডায় চোর ডাকাত, পকেটমার, তোলাবাজ তৈরি হচ্ছে।”
লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, “সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই।”
“কিছু বললেন?”
“না, এই বলছিলুম যে, বটু সর্দারের সঙ্গে তোমার দরকারটা কীসের?”
“দরকার তেমন কিছু নয়। শুনেছি গুণী মানুষ, একটু পায়ের ধুলো নিয়ে যেতুম।”
“আহা, তার জন্য অত দূরে যাওয়ার দরকার কী? এখানেই সেরে ফেললে হয়!”
গুরুপদ হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভারী অবাক গলায় বলল, “আপনিই বটু সর্দার নাকি? তা আপনাকে তো তেমন সাংঘাতিক লোক বলে মনে হচ্ছে না? দেখে তো ভয়ই লাগছে না মশাই!”
লোকটা একটু জড়সড় হয়ে বলল, “তা কেমন বটু সর্দার তোমার চাই বলো তো?”
গুরুপদ একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আহা, শত হলেও বটু সর্দার একজন ডাকসাইটে লোক তো, হাঁকে-ডাকে-প্রতাপে লহমায় চেনা যাবে, তবে না!”
লোকটা মাথা নেড়ে দুঃখের সঙ্গে বলল, “না বাপু, আমার কাছে তেমন বটু সর্দার নেই।”