মনোময় ভারী আপ্যায়িত হয়ে দু’হাত কচলে নরম গলায় বলল, “তা বাপু, তুমি যখন বটু সর্দারের লোক, তখন আমার একটা উপকার করে দিতেই হবে।”
“কীসের উপকার?”
মনোময় একটু হেঃ হেঃ করে নিয়ে বলল, “আমার ভাইপোটা পাশটাস করে বসে আছে, কিন্তু কাজকর্মে তেমন সুবিধে করে উঠতে পারছে না। তার খুব ইচ্ছে, বটু সর্দারের আখড়ায় গিয়ে একটু হাতের কাজ শিখে রোজগারে নেমে পড়ে। তা বটুর আখড়ায় তো শুনি বিদ্যের সমুদুর। পকেটমারি, ছিনতাই, কেপমারি, চুরি, ডাকাতি, ভোলাবাজি, ভাড়াটে খুন, কিডন্যাপিং, সবই শেখানো হয়। ওখান থেকে যারা পাশটাস করে বেরোয় তারা কেউ বসে নেই। কিন্তু বটুর আখড়ায় ঢোকা বড় শক্ত। অ্যাডমিশন টেস্ট আছে, ফিজিক্যাল ফিটনেস আছে, আই কিউ পরীক্ষা আছে। তা দেবে বাপু একটা ব্যবস্থা করে? বড় উপকার হয় তা হলে। এই তো কাছেই মগরাহাটিতে তার ঠেক, বড়জোর মাইলটাক হবে। বলো তো তোমার সঙ্গে গিয়ে আজই পাকা কথা সেরে আগাম দিয়ে যাই?”
গুরুপদ একটু থতমত খেয়ে গেল। এত ব্যাপার তো তার জানা ছিল না। তবে চট করে সামলে নিয়ে বলল, “সেই উপায় নেই মশাই। আমি এখন ডিউটিতে আছি।”
খপ করে তার হাত দুখানা ধরে মনোময় বলল, “আমার ভাইপোটার একটা ব্যবস্থা তোমাকে করে দিতেই হবে বাপু। তার ঝোঁকটা তোলাবাজির দিকেই। দিব্যি ভাল ব্যাবসা। এক পয়সা লগ্নি নেই, টহল দিয়ে বেড়াও আর টাকা তোলো।”
শুনে গুরুপদর ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! সে আমতা-আমতা করে বলল, “হ্যাঁ, তাই বা মন্দ কী? তবে আপনার নিজের ভাইপো বলেই বলছি, ওসব লাইনে ভাইপোকে নামানো কি ভাল?”
মনোময় চোখ কপালে তুলে বলল, “ভাল নয় মানে? বটু সর্দারের নাম তো লোকের মুখে-মুখে। এই তো নিশিগঞ্জের গোপাল দাস মাত্র দু’বছর আগে পাশ করে বেরিয়ে কুঁড়েঘর ভেঙে রাতারাতি তিনতলা বাড়ি তুলে ফেলল। ছিনতাইয়ের হাত এত ভাল, গলার হার বা কানের দুল এমন কায়দায় তুলে নেবে যে, কেউ টেরটিও পাবে না। নসিপুরে হাবু গুন্ডার কথাই ধরো না কেন। শুধু মস্তানি করে কোন মন্ত্রীর শাগরেদ হয়ে এখন লাখ টাকা কামাচ্ছে। বিদ্যাপুরের ফেন্টুকে চেনো? গাঁট আর পকেট কেটে তার এখন মারুতি গাড়ি। পিরতলার ভৈরব মণ্ডলের নাম তো খুব শুনে থাকবে। চারটে ব্যাংক লুট করে এত টাকা হাতে এল যে, রাখার জায়গা নেই। শেষে দুধেল গোরুটা বেচে দিয়ে গোয়ালঘরে গাদা করে টাকা রাখতে হয়েছে।”
গুরুপদর চোখ গোল থেকে আরও গোল হচ্ছিল। বটু সর্দারের তালিমের যে এত গুণ তা কে জানত? সে এক পা দু পা করে পিছু হটছিল। আমতা-আমতা করে বলল, “তা বটে। তবে কিনা…!”
মনোময় খুব আপ্যায়নের হাসি হেসে বলল, “অবিশ্যি তোমাকে এসব বলার মানেই হয় না। এ যেন মায়ের কাছে মাসির গপ্পো। তুমি নিজেই তো বটু সর্দারের নিজের হাতে তৈরি জিনিস! তা বাপু, তোমার হাতযশটা কীসে বলো তো?”
গুরুপদ ঘাবড়ে গেলেও কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল, “সে বলার মতো কিছু নয়। ওই একটু-আধটু হাতের কাজ শিখেছি আর কী।”
“আহা, তোমার বিনয়ের ভাবখানা দেখে বড় ভাল লাগল বাপু! নিজের গুণের কথা কি আর নিজের মুখে ফেঁদে বলা যায়? তবে তোমাকে দেখেই কিন্তু ঠিক চিনে নিয়েছি। একটু হাবাগোবা ভালমানুষের মতো চেহারাখানা বটে, কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারোনি। ভাব দেখেই মনে হয়েছিল, এ একেবারে তৈরি জিনিস। হেঃ হেঃ, ঠিক কি না?”
গুরুপদ একটু আঁতকে উঠে আর্তনাদের গলায় বলল, “আজ্ঞে, না, অতটা নয়।” মনোময় ভারী আহ্লাদের গলায় বলল, “না বললে শুনছে কে হে? দাঁড়াও, অত বড় মানুষের চেলা তুমি, পাঁচজনকে ডেকে একটু দেখাই। সবাই চিনে রাখুক তোমাকে।”
বলেই মনোময় পিছু ফিরে টারজানের মতো মুখের দু’পাশে দু’ হাত চোঙার মতো করে, “ওরে শিবু, ও ষষ্ঠীপদ, ওরে মান্তু, ট্যাপা, গিরিজা, ধেয়ে আয় রে, ছুট্টে আয়। দেখে যা কাকে পাকড়াও করেছি…!”
ষন্ডা চেহারার ছ’-সাতজন ছেলে-ছোঁকরা ধেয়ে-পেয়ে আসছিল।
গুরুপদ ঠিক বুঝতে পারছিল না, ব্যাপারটা কী হচ্ছে? ঠিক এই সময় তার ডান হাতে একটা হ্যাঁচকা টান পড়ল। কে যেন তাকে প্রায় হিঁচড়ে নিয়ে যেতে-যেতে বলল, “পালাও! পালাও?”
হাটের গিজগিজে ভিড়ের ভিতর দিয়ে দিব্যি ফঁক-ফোকর গলে একটা মাঝবয়সি লোক তার নড়া ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গুরুপদ একবার “করেন কী! করেন কী!” বলে আপত্তি জানিয়েছিল বটে! কিন্তু লোকটা একটা ধমক দিয়ে বলল, “চুপচাপ ছুটতে থাকো। কোনও কথা নয়।” পিছনে কারা যেন রে রে করে তেড়ে আসছে বলেও টের পেল সে। গুরুপদর আর আপত্তি হল না।
লোকটা লহমায় তাকে দু’ সার দোকানঘর পেরিয়ে একটা খড়ের গাদার পিছনে এনে দাঁড় করাল। গুরুপদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এটা কী হল?”
লোকটার পরনে একটা মালকোঁচা মারা আট করে পরা হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা মেটে রঙের ফতুয়া। মাথায় ছোট করে ছাঁটা কাঁচাপাকা চুল, খুঁড়ো গোঁফ আর গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। বেশ হাড়ে-মাসে পোক্ত চেহারা। জুলজুল করে তার দিকে চেয়ে ছিল। ভারী অবাক গলায় বলল, “কিছু খারাপ করলুম নাকি?”
গুরুপদ বলল, “খারাপ করলেন না? একটা লোকের সঙ্গে দুটো কাজের কথা হচ্ছিল, কোথা থেকে চেনা নেই, জানা নেই, বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ এসে নড়া ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে হিড়হিড় করে টেনে আনলেন যে বড়? কাজটা কি ভাল হল মশাই?”