“এখানে বিজয়পদ রায় বলে কেউ আছেন?”
বিজয়বাবু শশব্যস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমিই।”
সাহেব হাত বাড়িয়ে বিজয়বাবুর হাত চেপে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “আমার নাম লু আর্চার। আমি একটা খবর পেয়েই আপনার কাছে এসেছি। যদি একটু সময় দেন!”
“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, বসুন!”
সাহেব একটা প্রকাণ্ড অ্যাটাচিকেস সামনের টেবিলে রেখে বসলেন। তারপর বললেন, “আপনি বোধ হয় আমার ঠাকুরদা নাথান আর্চারের নাম শুনে থাকবেন। তিনি আছাপুর নামে একটা জায়গায় থাকতেন। আসলে জায়গাটার নাম হয়েছিল আমার এক পূর্বপুরুষ জন আর্চারের নামে। আগে ‘আর্চারপুর’ বলা হত। পরে লোকের মুখে-মুখে হয়ে দাঁড়ায় ‘আছাপুর। এখন আর সেই নামটাও নেই। এখন জায়গাটার নাম ‘গোপালহাটি।”
বিজয়বাবু বললেন, “আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। নাথান আর্চার আমার ঠাকুরদার বন্ধু ছিলেন।”
“জন আর্চারের কাছে একটি খুব দুষ্প্রাপ্য বই ছিল। একটা হিব্রু ভাষার বাইবেল। আমাদের যতদূর জানা আছে, নাথান আর্চারের কাছেও বাইবেলটা ছিল। তারপর বাইবেলটা কোথায় গেল তার আর খোঁজ পাওয়া যায় না। কিন্তু আমি একটা উড়োখবর পেয়েছিলাম যে, বাইবেলটা এই অঞ্চলেই কারও কাছে এখনও আছে। বইটার বিশেষত্ব হল, জন আর্চার ওটিকে কোথাও একটা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে যান। তাই প্রায় চারশো বছরের পুরনো বইটা হয়তো এখনও অক্ষত আছে। একজন বড় শিল্পীর হাতে লেখা আগাগোড়া ক্যালিগ্রাফি করা বইটার আর্থিক ভ্যালু এখন সাংঘাতিক। আমি তাই এই বইটার হদিশ পাওয়ার জন্য একজন লোককে কাজে লাগাই। তার সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, বইটার খোঁজ দিতে পারলে তাকে আমি মোটা টাকা দেব। মাত্র কিছুদিন আগে সে আমাকে বইটার সন্ধান দিয়েছে।”
বিজয়বাবু সবিস্ময়ে বললেন, “আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। বইটা আমার কাছেই আছে। আপনি নিয়ে যেতে পারেন।”
লু আর্চার একটু হেসে বললেন, “বইটা কি আপনি আমাকে বিনা পয়সায় দেবেন?”
“নিশ্চয়ই। ওই বই তো আমার কাজে লাগে না। আমি হিব্রু ভাষা জানি না।”
“ভাল করে ভেবে দেখুন মিস্টার রায়। বইটা যদি এখন সদেবি বা ক্রিস্টির নিলামে ওঠে তা হলে ওর দাম এখন কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত উঠতে পারে। ভ্যাটিকান বা অন্যান্য চার্চ এই বাইবেলটির জন্য যে-কোনও মূল্য দিতে রাজি। সুতরাং আপনি দিলেও আমি বইটা বিনামূল্যে নিতে রাজি নই। তবে আমি আপনাকে তো বেশিও দিতে পারব না। আমি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা নিয়ে এসেছি।”
বিজয়বাবুর প্রায় ভিরমি খাওয়ার জোগাড়!
লু আর্চার অ্যাটাচিকেসটা খুলতে খুলতে বললেন, “আর যে লোকটা এই বাইবেলের সন্ধান আমাকে দিয়েছে, সেই বটু সর্দারকে দশ লক্ষ টাকা।”
বাড়ির সবাই পিছনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। কে একজন বলে উঠল, “বটু তো চোর!”
বাংলা কথাটা বুঝতে সাহেবের একটু সময় লাগল। বিজয়বাবু ইংরেজি করে বুঝিয়ে দেওয়ার পর সাহেব একটু ভ্রু-কুঞ্চন করে বললেন, “বটু সর্দার চোর? এটা কি রসিকতা নাকি? বটু সর্দার যদি চোরই হবে, তা হলে সে তো বাইবেলটা অনেক আগেই নিয়ে গিয়ে আমাকে সরাসরি বিক্রি করে দিতে পারত! কারণ, বাইবেলটার দাম তার ভালই জানা ছিল। সে তো তা করেইনি, উপরন্তু পাছে বাইবেলটা কেউ হাতিয়ে নেয়, তার জন্য সে এই বাড়িতে থেকে সেটা পাহারা দিয়েছে।”
বিজয়বাবু স্খলিত কণ্ঠে বললেন, “বটু সর্দার এখন পুলিশের হেফাজতে।”
লু আর্চার বললেন, “সেটা আমি শুনেছি। তার অপরাধ কী জানি না। সেটা আপনারাই ভাল জানবেন। কিন্তু কয়েকদিন আগেই সে আমাকে জানিয়েছে, বাইবেলের দাম পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পাবে আপনাদের পরিবার, কিন্তু বটু সর্দারের ভাগের দশ লক্ষ টাকা পাবে আপনাদের ছোটভাই গুরুপদ রায়।”
সবাই প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, “গুরুপদ?” সাহেব বললেন, “হ্যাঁ। গুরুপদ রায়েরনাকি একটা মোটরবাইকের শখ! আর বাকি টাকা দিয়ে সে একটা দোকান দেবে। গুরুপদ রায় বটু সর্দারকে অসময়ে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ায় বটু সর্দার তার কাছে কৃতজ্ঞ।”
পিছনে ভিড়ের মধ্যে একটা ফোঁপানির শব্দ পাওয়া গেল। শশীমুখী কাঁদছেন।
সাহেব একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “মিস্টার রায়, তা হলে এবার দয়া করে টাকাটা গুনে নিয়ে আমাকে এই রসিদে সই করে দিন, আর বাইবেলটা নিয়ে আসুন।”
“মিস্টার আর্চার, আর-একটা কথা। বাইবেলটার মধ্যে একটা গুপ্তধনের নকশা ছিল।”
লু আর্চার হাসলেন, “হ্যাঁ, বটু সর্দার অনেক আগেই নকশাটা আমাকে দেখিয়েছে। আমার মনে হয়, ওটা একটা ধোঁকা ছাড়া কিছু নয়। জন আর্চার তার সব টাকাপয়সা ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে তাঁর গুপ্তধন থাকার কথা নয়। লোভী মানুষের মনোযোগ বাইবেল থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই তিনি ওই নকশা বাইবেলে ঢুকিয়ে রাখেন। অন্তত আমার তাই ধারণা।”
লু আর্চার বাইবেল নিয়ে চলে যাওয়ার পর বাড়িতে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পাওয়ার আনন্দের কোনও হইচই উঠল না। কারও মুখে হাসি বা খুশির চিহ্নমাত্র ফুটে উঠতে দেখা গেল না। গুরুপদকে যখন দশ লক্ষ টাকার খবর দেওয়া হল, তখন সে নিজের বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল। খবরটা শুনে ওই অবস্থাতেই মুখ না তুলে বলল, “ও টাকা তোমরাই নাও গে, আমার দরকার নেই!”