“সেটা কি ঠিক হবে? শত হলেও অতিথি নারায়ণ!”
“নারায়ণ না বিভীষণ! এরকম অতিথিকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করতে হয়।”
“তোমার তো ওই দোষ! চট করে উত্তেজিত হয়ে পড়ো। এমনও তো হতে পারে যে, বটুবাবু একটা চোরকে ধরে ফেলেছেন। ধরে এখন তাকে ঘরে বসিয়ে নানারকম সদুপদেশ দিচ্ছেন। তাতে চোরটার হয়তো ভারী অনুশোচনা হচ্ছে। সে হয়তো এখন চোখের জল ফেলতে ফেলতে কৃতকর্মের জন্য জ্বলেপুড়ে মরছে। তাতে হয়তো লোকটা ধীরে ধীরে ভাল হয়ে যাচ্ছে…?”
ঠিক এই সময় দরজার বাইরে থেকে কে যেন ভারী বিনয়ের গলায় বলে উঠল, “বড়কর্তা কি জেগে আছেন নাকি?”
অজয়পদ আঁক করে খানিকটা বাতাস গিলে ফেললেন। গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। শরীরে স্তম্ভন। শশীমুখী তেড়ে উঠে বললেন, “কে রে?”
“আজ্ঞে মাঠান, আমি বটু সর্দার। বলছি কী, একগাছ দড়ি হবে মাঠান?”
“দড়ি! এত রাতে দড়ি দিয়ে কী হবে?”
“আর কবেন না মাঠান! দুটো অপোগণ্ড, এসে জুটেছে। আনাড়ির হদ্দ। তাদের একটু শিখিয়ে-পড়িয়ে দিচ্ছি আর কী। বন্ধন মোচন বিদ্যের কথা কি শুনেছেন মাঠান?”
“না বাপু, শুনিনি।”
“ভারী কাজের জিনিস মাঠান। পিছমোড়া করে বা হেঁটমুক্ত করে বেঁধে রাখলে কোন কায়দায় তা খুলে ফেলা যায় সেইটাই শেখাচ্ছি আর কী।”
“না বাপু, এ ঘরে দড়িদড়া নেই।”
“আছে বই কী মাঠান, খুব আছে। আপনার খাটের পায়ের দিকে ডান দিকের কোণে আলনার পিছনে দেওয়ালের পেরেকে ঝোলানো একটা চটের থলির মধ্যে হাত ঢোকালেই একগাছা মজবুত পাটের দড়ি পেয়ে যাবেন, আজ্ঞে।”
শশীমুখী চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী সব্বোনেশে লোক দেখেছ!”
অজয়পদ ফাসফেসে গলায় বললেন, “দিয়ে দাও, চায় সব দিয়ে দাও, শুধু দড়ির উপর দিয়ে গেলে তবু রক্ষে।”
শশীমুখী কম্পিতবক্ষে উঠে দড়িগাছা জানলা গলিয়ে বারান্দায় ফেলে দিয়ে এসে অজয়পদর পাশে বসে বললেন, “ভয়ে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে, আমি বোধ হয় মূৰ্ছাই যাব।”
অজয়পদ খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “মূৰ্ছা যাবে মানে? গেলেই হল? আমার অনেকক্ষণ আগেই মূৰ্ছা পেয়েছে, এতক্ষণ চেপেচুপে ছিলুম। আগে আমারটা হয়ে যাক, তারপর তুমি!” বলেই অজয়পদ বিছানায় চিতপাত হয়ে মূৰ্ছা গেলেন।
কাকভোরে শশীমুখীর চেঁচামেচিতে বাড়ির লোকের ঘুম ভাঙল। পাড়া-প্রতিবেশীরাও ছুটে এল দুদ্দাড় করে।
শশীমুখী উঁচু গলায় বলছিলেন, “ও গুরুপদ, এ কোন সব্বোনেশে লোককে বাড়িতে এনে তুলেছিস? এ যে চোরের সর্দার, ডাকাতের চাঁই, খুনে-গুন্ডাদের গুরুঠাকুর! খাল কেটে কুমির এনেছিস পোড়ারমুখো? সব যে ছারখার হয়ে যাবে রে!”
সদ্য ঘুম থেকে উঠে আসায় সবাই খানিকটা তটস্থ, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, হতবুদ্ধি।
পাড়া-প্রতিবেশীদের দিকে চেয়ে শশীমুখী করুণ গলায় বললেন, “ওগো, তোমরা সব দাঁড়িয়ে দেখছ কী? শিগগির এই বজ্জাতকে বিদেয় করার ব্যবস্থা করো! নিশুতরাতে ঘরে চোর-ঠ্যাঙাড়েদের পাঠশালা বসিয়েছে গো! যত রাজ্যের চোর-ডাকাত নিশুতরাতে এসে জড়ো হচ্ছে।”
ব্যাপারটা বুঝে উঠতে লোকের একটু সময় লাগল বটে, কিন্তু তারপরই চারদিকে একটা চেঁচামেচি হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। গাঁয়ের মাতব্বররাও সব এসে জুটলেন। সব শুনে তাঁরাও আঁতকে উঠলেন, “সর্বনাশ! গোপালহাটিতে কি শেষে চোর-ডাকাতের আঁতুড়ঘর তৈরি হবে! কোথায় সেই বদমাশ? ধরে আন তাকে!”
দশ-বারোজন ছেলে-ছোঁকরা মুহূর্তের মধ্যে গিয়ে বটু সর্দারের ঘর থেকে তাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে এল।
“কী হে বটু, এসব কী শুনছি?”
বটু জুলজুল করে মাতব্বরদের মুখের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে মাঠান, সত্যি কথাই বলছেন।”
“তোমার ঘরে রাতবিরেতে চোর-ডাকাতরা আসে?”
“যে আজ্ঞে।”
“তুমি তাদের চুরি-ডাকাতি শেখাও?”
“আর কী শেখাব, অন্য বিদ্যে তো জানি না।”
“সর্বনাশ! দেশ যে রসাতলে যাবে! ওরে, তোরা থানায় খবর দে।”
লোক থানায় খবর দিতে গেল বটে। কিন্তু তার আগেই বটুর উপর বিস্তর চড়চাপাটি, ঘুসি আর লাথি শুরু হয়ে গেল। কে যেন একবার চেঁচিয়ে বলার চেষ্টা করল, “ওরে, বুড়োমানুষ! মরে না যায়, দেখিস!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! হাটুরে মার যখন শুরু হয় তখন তাকে ঠেকানো ভারী শক্ত। বটুও ঠেকানোর কোনও চেষ্টা করল না। খানিক পর বারান্দার নীচে উঠোনে গড়িয়ে পড়ে গেল। কষ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, চোখ উলটে গিয়েছে, মুখে-চোখে রক্তাভা। দড়ি দিয়ে অচৈতন্য বটুকে বারান্দার থামের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বেঁধে রাখা হল। লোকজন ঘিরে রইল পাহারায়।
একটু বেলার দিকে সেপাই নিয়ে যতীন দারোগা এলেন। সব শুনলেন মন দিয়ে। তারপর বটুকে গ্রেফতার করে নিয়ে চলে গেলেন।
৭. বটু সর্দার বিদেয় হওয়ায়
বটু সর্দার বিদেয় হওয়ায় রায়বাড়ি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। জোর একটা ফাঁড়া কেটে গিয়েছে। নইলে যে কী সর্বনাশ হয়ে যেত কে জানে! শশীমুখীর সাহসেরও বেশ প্রশংসা হল চারদিকে। শুধু দু’জন লোকই এই ঘটনায় তেমন খুশি নয়। একজন গুরুপদ। সে বেশি কথাটথা বলে না, চুপচাপ খেয়ে উঠে গিয়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকে। আর একজন বিজয়বাবু। তিনি মাঝে-মাঝেই বলেন, “লোকটাকে যতটা খারাপ বলে ভাবা হচ্ছে, ততটা বোধ হয় নয়। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আমাদের।”
যাই হোক, তিন-চারদিন পরে একদিন সকালে হঠাৎ একটা পেল্লায় কালো রঙের ঝাঁ-চকচকে গাড়ি এসে রায়বাড়ির সামনে থামল। তা থেকে নেমে এলেন লালমুখো এক লম্বা-চওড়া সাহেব। সঙ্গে এক আরদালি গোছের লোক।