বটু সর্দার মিটমিটে চোখে চেয়ে বলল, “কী বলতে চাইছিস?” চোর হাত কচলে বলল, “ছেলেবেলা থেকে লোকের মুখে মুখে যার নাম শুনে আসছি, যাকে একবার চোখের দেখা দেখবার জন্য দশ মাইল দৌড় করতেও রাজি আছি, যার নাম শুনলে এখনও সাতটা মহল্লার লোক মাথা নিচু করে, সেই বটু সর্দারের কাছেই তো এসেছি, আজ্ঞে। একটু কেরানি দেখিয়ে আপনাকে ভেজাব বলে সোজা পথে না এসে একটু বাঁকা পথে আসতে হয়েছে।”
বটু সর্দার একটা বড় শ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, “বৃথাই হয়রান হলি বাবা! সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। তিন কুড়ি বয়স হল, বেজা মল্লিকের হুড়ো খেয়ে ভদ্রাসন ছেড়ে আলায় বালায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, দলবল ভেঙে গিয়েছে। না রে, বটু সর্দার আর বেঁচে নেই।”
চোরটা টক করে বটুর পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে বলল, “আজ্ঞে, মরা হাতি লাখ টাকা।”
বটু গায়ের কম্বলটা আরও একটু জড়িয়ে বসে বলল, “তা তুই কে রে?”
“আজ্ঞে, আমার নাম কেদার। বাইরে আমার আরও এক বন্ধু আপনার শ্রীচরণ দর্শনের জন্য অপেক্ষা করে আছে। ফটিক। যদি অনুমতি দেন তো তাকেও ডাকি।”
“আর ধ্যাষ্টামো করতে হবে না। তুই কোন অনুমতি নিয়ে
ঢুকেছিলি? ডেকে আন, এই ঠান্ডায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।”
কিছুক্ষণ পরে আরও-এক ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকে একেবারে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল বটুকে।
কেদার বলল, “আজ্ঞে, আমরা বেজা মল্লিকের লোক।”
বটু অবাক হয়ে বলল, “বেজা মল্লিক! সে তোদের পাঠিয়েছে নাকি? তা হলে আর দেরি কেন বাবারা, বন্দুক, পিস্তল, ছোরাছুরি যা
আছে বের করে ফ্যাল। আধমরা তো হয়েই আছি, বাকিটুকু তাড়াতাড়ি সেরে চলে যা। গয়েশপুরের গোরাং গনতকার বলেও ছিল বটে যে, তিন কুড়ি বয়সে আমার একটা জব্বর ফাঁড়া আছে।”
দু’জনেই পটাং করে তার পায়ের উপর পড়ে গেল। কেদার বলল, “না মশাই, না। আপনাকে মারলে যে আমাদের হাতে কুষ্ঠ হবে। বেজা মল্লিক আপনাকে খুন করতে পাঁচ হাজার টাকা কবুল করেছে বটে, কিন্তু আমরা ওর মধ্যে নেই।”
“তবে তোরা চাস কী?” কেদার গদগদ হয়ে বলল, “বিদ্যার জাহাজ আপনি। আমাদের একটু শিক্ষে-টিক্ষে দেন। রেচক, পূরক, কুম্ভক, বায়ুবন্ধন, সর্পভয়, সারমেয় ভয় নিবারণ, যোগিনীবিদ্যা, ঘুমপাড়ানি মন্তর, সর্পগতি, ব্যাঘ্রগতি, বানরগতি, হস্তলাঘব, পদলাঘব, কত কী জানা আছে আপনার! ওর ছিটেফোঁটাও যদি শিক্ষে করতে পারি, তা হলে কি আর বেজা মল্লিকের মতো পাষণ্ডের শাগরেদি করি? খুন, জখম, লুটপাট ছাড়া সে আর কিছু জানেই না। সত্যি বলতে কী, খুন-জখম, মারদাঙ্গা আমাদের মোটে সহ্য হয় না। এসব কাজে আর্ট নেই। মোটা দাগের কাজ।”
বটু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ওরে, আমার যে তিন কুড়ি…!”
“পায়ে ঠেলবেন না মশাই, অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আসতে হয়েছে। বেজা মল্লিকের শাগরেদ শ্যামলাল আপনার খবর বেজা মল্লিককে পৌঁছে দিয়েছে। বেজা মল্লিক আমাদেরই পাঠিয়েছে আপনাকে নিকেশ করতে। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছি। আপনাকে একবার চোখের দেখা দেখতে পাব বলে।”
বটু অনিচ্ছের সঙ্গে বলল, “তোরা বড় মুশকিলে ফেললি দেখছি।”
.
লোকে বলে, শশীমুখী নাকি বিড়ালের পায়ের শব্দও শুনতে পান। তা কথাটা খুব একটা মিথ্যেও নয়। শশীমুখীর কান বড় সজাগ। কান সজাগ, চোখ সজাক, নাক সজাগ।
মাঝরাতে কাছেপিঠে একাধিক লোকের নিচু গলায় কথা হচ্ছে শুনতে পেয়ে স্বামী অজয়পদকে ঠেলা দিলেন শশীমুখী। কিন্তু অজয়বাবুর ঘুম ভাঙল না। শীতকাতুরে রোগাভোগা লোক, হাঙ্গামা হুজ্জুতে ভয় পান। কিন্তু শশীমুখীর ভয়ডর বলে কিছু নেই। দরজার বাটামটা খুলে সেটাই বাগিয়ে ধরে ভিতরের বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তারপর সন্দেহজনক ঘরটার দরজায় কান পেতে সব কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন।
কিন্তু যা শুনলেন, তাতে সাহসিনী শশীমুখীরও বুক ধড়ফড় করতে লাগল, মাথা ঝিমঝিম করে সরষেফুল দেখতে লাগলেন। প্রায় মূৰ্ছাই যান আর কী! কোনওরকমে গিয়ে অজয়পদকে ঠেলে তুলে বললেন, “ওগো, গুরুপদ পোড়ারমুখো ও কোন সব্বোনেশে লোককে বাড়িতে এনে তুলেছে? এ যে চোরেদের সর্দার, ডাকাতদের চাই, খুনে বদমাশ গুন্ডাদের গুরুঠাকুর! এ যে খাল কেটে কুমির এনেছে গো!”
“অ্যাঁ! কী সর্বনাশ!”
“নিশুতরাতে ঘরে চোর-ঠ্যাঙাড়েদের পাঠশালা বসিয়েছে। প্রথমদিন দেখেই বুঝেছিলুম ও একটা মিটমিটে ডান। ওই আহাম্মক গুরুপদকে ভুজুংভাজুং দিয়ে এ বাড়িতে সুচ হয়ে ঢুকেছে, এবার ফাল হয়ে বেরোবে। বিশ্বাস না হয় আমার সঙ্গে এসো, নিজের কানে শুনে যাও…!”
অজয়পদ সভয়ে শশীমুখীর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, “পাগল নাকি? ওসব শোনা খুব খারাপ।”
শশীমুখী ধমক দিয়ে বললেন, “তা বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে নাকি? গিয়ে একটু হাঁকডাক করো!”
অজয়পদ কুঁকড়ে গিয়ে বললেন, “সেটা কি ভাল দেখাবে? অন্যের কথাবার্তার মধ্যে নাকগলানো কি ভাল? ওঁরা হয়তো ভারী অসন্তুষ্ট হবেন। ভাববেন, অজয়বাবুর এ কীরকম ব্যবহার!”
“ভাবলে ভাবুক। তোমাকে এখন ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে, ওঠো তো, ওঠো!”
অজয়বাবু সিঁটিয়ে গিয়ে বললেন, “আচ্ছা, আচ্ছা, আগে সকালটা হতে দাও, তারপর তোকজন জড়ো করে না হয়…!”
“বলো কী? ততক্ষণে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে! এক্ষুনি লোকটাকে বাড়ি থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় না করলেই নয়!”