চোখে-মুখে ঠান্ডা জলের ঝাঁপটা খেয়ে নিতাই আর পানু যখন চোখ মেলল, তখন শীতের বেলা অনেকটাই চলে গিয়েছে। ঝাঁপসা চোখে তারা সামনে কালান্তক যমের মতো বেজা মল্লিককে দেখে আঁতকে উঠে কাঠ হয়ে গেল। কোনওরকমে কেতরে ককিয়ে উঠে বসে নিতাই হ্যাঁদানো গলায় বলল, “আমাদের মারবেন না বেজাবাবু, আমাদের দোষ নেই।”
বেজা মল্লিক অনুত্তেজিত ঠান্ডা গলায় বলল, “তাই বুঝি?”
“আপনাকে না জানিয়ে আপনার এলাকায় কোনও কাজে কখনও হাত দিয়েছি, বলুন?”
বেজাবাবু গম্ভীর হয়ে বলল, “এই জালি নকশা তোরা কোথায় পেলি?”
পানু বলল, “নকশা জালি নয় বেজাবাবু। সেই পুরনো বাইবেল আর আসল নকশা নিয়ে পরশু রাতে স্বয়ং বটু সর্দার এখানে মাটি খুঁড়ছিল।”
“বটু সর্দার! ঠিক জানিস বটু সর্দার?”
“দূর থেকে হ্যারিকেনের আলোয় দেখা। রাতে কুয়াশাও ছিল। হলফ করে বলতে পারব না। তবে দু’জন লোক এসেছিল। বুড়োজনকে দূর থেকে বটু সর্দার বলে মনে হয়েছে আমাদের দু’জনেরই।”
“তারপর?”
“সুযোগ হাতে এসে যাওয়ায় আমরা তাড়া করে যাই। গুলিও চালিয়েছিলাম। ওরা বাইবেলখানা আর নকশাটা ফেলেই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়। আমরা দুটো জিনিসই ভাল করে পরীক্ষা করে দেখেছি। সেটা পুরনো সেই বাইবেলই বটে, আর নকশাখানাও আসল।”
“সে দুটো এখন কোথায়?”
“সে দুটো এখানেই থাকার কথা। কিন্তু গাঁয়ের লোকের হুজুতে কী হয়েছে বলতে পারব না।”
বেজাবাবু আষাঢ়ে মেঘের মতো মুখ করে বলল, “দ্যাখ নিতাই, গত দশ বছর ধরে এই মহল্লার গায়ে-গাঁয়ে সেই পুরনো বাইবেল আর তার ভিতরে রাখা নকশাখানার খোঁজ হচ্ছে। কারও কাছে সন্ধান পাওয়া যায়নি। তোরা কি বলতে চাস, পরশু রাতে হঠাৎ করে তোদের হাতের নাগালে বাইবেল আর নকশা স্বয়ং মা কালীই এগিয়ে দিল! না কি আর-একটা গল্প ফেঁদে আমাদের হয়রান করতে চাইছিস?”
নিতাই হাঁফসানো গলায় বলল, “না বেজাবাবু, মাকালীর দিব্যি করেই বলছি, বাইবেল আর নকশা বাস্তবিকই আমাদের হাতে এসে গিয়েছিল। কপালের ফের ছাড়া আর কী বলি বলুন? গাঁয়ের লোকগুলো হুড়ো না দিলে…!”
বেজাবাবু বজ্রকণ্ঠে বলল, “তবে শোন, গাঁয়ের লোকেরা বিস্তর খোঁড়াখুঁড়ি করেও গুপ্তধনের কিছুই পায়নি। আর তারও আগে ওই নকশা জেরক্স কপি করে বাজারে কাল সকালে বিলি করা হয়েছিল। নকশাটা যদি আসলই হবে, তা হলে সেটা কি কোনও আহাম্মক বিলি করে বেড়ায়?”
নিতাইয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। সে স্খলিত কণ্ঠে বলল, “অ্যাঁ! এ খবর তো আমাদের জানা ছিল না বেজাবাবু!”
পানু হতাশ গলায় বলল, “হ্যাঁ বটে, গাঁয়ের লোকের হাতে লিফলেটের মতো কী যেন ছিল বটে!”
বেজাবাবু বলল, “নিতাই, তুই একসময় বটু সর্দারের চেলা ছিলি, একটা কথার সাফ জবাব দে। তুই কি এখনও বটু সর্দারের হয়ে কাজ করছিস? তোকে সামনে রেখে আড়াল থেকে বটু আমাকে ঘোল খাওয়াবার চেষ্টা করছে না তো?”
“না বেজাবাবু, মা কালীর দিব্যি।”
“তা হলে যা, এবারের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। এ তল্লাটে ফের ঢুকবি তো লাশ হয়ে বেরোবি।”
৬. বাঘা শীত আর হাকুচ অন্ধকারে
বাঘা শীত আর হাকুচ অন্ধকারে একজন লোক গোপালহাটির রায়বাড়ির পশ্চিম দিককার একটা ঘরের জানলার গ্রিল খুব মন দিয়ে আধঘণ্টার চেষ্টায় নিঃশব্দে খুলে সরিয়ে ফেলতে পারল। তার হাতযশ কিছু কম নেই। মহল্লায় তার বেশ সুখ্যাতি আছে। একটু দম নিয়ে মা কালী আর বাবা বিশ্বকর্মাকে একটা করে নমো ঠুকে সে ‘দুর্গা’ বলে জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু ঢুকেই তার একগাল মাছি। সামনেই চৌকিতে উবু হয়ে বসা একটা লোক তাকে জুলজুল করে দেখছে। তার ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা।
উবু হয়ে বসা লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, “ছ্যাঃ ছ্যাঃ, এই তোর কাজের ছিরি! একটা গ্রিল সরাতে আধঘণ্টা, রেওয়াজ করিস না নাকি? অমন হাঁচোড়-পাঁচোড় করে কি গেরস্তর ঘরে ঢুকতে হয় রে আহাম্মক? যেন পদ্মবনে হাতির প্রবেশ! তার উপর হাপরের মতো হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাঁফাচ্ছিস! এটুকু মেহনতেই দমসম হয়ে গেলি বাবা? এসব দেখেই তো মাঝে-মাঝে আমার কাশী চলে যেতে ইচ্ছে হয়।”
লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “কোথায় ভুলটা হল বলুন তো?”
“আগাগোড়াই ভুল! তোর মাথা থেকে পা পর্যন্তই তো ভুল! গায়ে ঝুড়ি-ঝুড়ি মাংস, চালচলতি গদাই লস্করের মতো, হাত-পায়ে চটপটে ভাবটাই নেই। ঘরে যে একটা জাগা-মানুষ বসে আছে, সেটা অবধি আগাম টের পেলি না। তার উপর এত কসরত করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঢুকলি কিনা একটা ভুল ঘরে?”
চোরটা যেন একটু আঁতকে উঠে বলল, “ভুল ঘরেই ঢুকলাম নাকি?”
“তা ঢুকিসনি! এ ঘরে যে চোরের অম্বুবাচী! তা কার কাছে তালিম নিয়েছিলি?”
চোরটা ভারী জড়সড় হয়ে বলল, “আজ্ঞে, নমস্য নবকান্ত গুছাইতের কাছে।”
লোকটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “পলাশডাঙার নব নাকি?”
“আজ্ঞে, তিনিই।”
“তা নব তো হ্যাঁন্যাকা লোক নয়, পেটে বিদ্যে আছে। তোদের দোষ কী জানিস? ভাল করে কাজ না শিখেই রোজগার করতে নেমে পড়িস! ওতেই তো ওস্তাদের বদনাম হয়।”
চোর মাথা চুলকে বলল, “শেখার তো ইচ্ছেও ছিল মশাই, কিন্তু পাপী পেটের যে তর সয় না। পেটের জ্বালাতেই নেমে পড়তে হয়েছে।”
“তাতে লাভ কী হল বল? মেহনতটাই তো জলে গেল?”
চোরটা এবার একগাল হেসে মাথা নেড়ে বলল, “না, জলে যাবে কেন? ঠিক জায়গায়, ঠিক মানুষটির কাছেই তো এসেছি।”