“সার্ভেয়ারের তো বন্দুক থাকার কথা নয়!”
নিতাই বলল, “আমাদের সিকিউরিটির জন্য বন্দুক রাখতে হয়। সরকারের কাজে বাধা দিয়ো না, সরে পড়ো।”
সামনের লোকগুলো নিজেদের মধ্যে একটু কথা বলাবলি করে নিচ্ছিল, তাদের পিছন থেকে হঠাৎ কয়েকজন ছেলেছোঁকরা চেঁচিয়ে বলে উঠল, “এরা আমাদের গুপ্তধন চুরি করে নিতে এসেছে! ওই দ্যাখো কত জিনিস মাটি খুঁড়ে তুলে এনেছে!”
তারপরই মারমার করে ক্ষিপ্ত জনতা তেড়ে এল। দমাদম লাঠিসোঁটা পড়তে লাগল তাদের গায়ে, মাথায়, হাতে।
নিজেদের বাঁচানোর জন্য হাতখানাও তোলার সাধ্য ছিল না নিতাই আর পানুর। ঝিমিয়েই ছিল, মার শুরু হতেই অজ্ঞান হয়ে গেল। তাদের তুলে আনা জিনিসপত্র লুঠপাট হয়ে যেতে তিলার্ধ বিলম্ব হল না।
বহু লোক গর্তে নেমে আরও খোঁড়াখুঁড়ি করে কেউ একখানা কাঁটাচামচ, কেউ কলমদানি, কেউ একখানা মরচে-পড়া ছুরি এইসব পেয়ে যেতে লাগল। শেষমেশ ঘড়াও বেরিয়ে পড়ল বটে। তবে দেখা গেল সেগুলো মোটেই মোহরের ঘড়া নয়, জল রাখবার বেলেমাটির ঘড়া। আগেকার দিনে জল ঠান্ডা করার জন্য মাটির নীচে পাতালঘরে এসব ঘড়ায় রাখা হত।
ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে ফলসাবনের ঝুপসিতে একখানা পাকুড়গাছের ছায়ায় লম্বা, সটান, কালো আর মজবুত চেহারার একজন লোক আড়াল থেকে গোটা দৃশ্যটা খুব ঠান্ডা চোখে দেখে নিচ্ছিল। তার মাথায় বাবরি চুল, মস্ত পাকানো গোঁফ, হাতে একটা পাকা বাঁশের লম্বা লাঠি। তার পিছনে ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে আরও জনাচারেক গম্ভীর ও মজবুত চেহারার লোক চুপচাপ খাপ পেতে বসে আছে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। তবে তাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে।
ওগুলো পাওয়া না গেলেও গাঁয়ের লোক বেশ খুশিই। অনেকদিন পর গা গরম করা একটা কিছু তো হল। তা ছাড়া কেউ শুধু হাতেও ফিরছে না। ছোটখাটো জিনিস সবাই এক-আধটা পেয়েছে। তাই বা মন্দ কী? দুপুর গড়ানোর আগেই ধীরে-ধীরে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। মস্ত শিশুগাছের তলায় শুধু নিতাই আর পানু অজ্ঞান হয়ে চিতপটাং পড়ে আছে।
ধীরে-ধীরে লম্বা লোকটা এসে খোঁড়াখুঁড়ির জায়গাটায় দাঁড়িয়ে চারদিকটা ভাল করে লক্ষ করল। তার পিছনে গম্ভীর চারটে লাঠিধারী ষন্ডা চেহারার মানুষ।
লম্বা লোকটা একটা কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে একটু দেখল। তারপর স্যাঙাতদের একজনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “এই সেই গুপ্তধনের নকশা।”
স্যাঙাতটা বলল, “হু। এটাই জেরক্স করে বিলি করা হয়েছে তো?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু কেন বেজাবাবু? মতলবটা কী?”
“বুঝলি না? যে বিলি করেছে সে ভালই জানত, এখানে গুপ্তধন নেই। কিন্তু নিতাই আর পানু লোভী। ওদের কোনওভাবে নকশাটা গছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর ব্যবস্থা করার জন্য নকশাটার জেরক্স বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়।”
“কিন্তু করলটা কে?”
“যে করেছে তার টিকির নাগাল পেতে গত পাঁচবছর ধরে আমি কম হয়রান হইনি। দু’বার বাগে পেয়েও ছিলাম, কিন্তু পিছলে বেরিয়ে গিয়েছে।”
“এ কি বটু সর্দারের কাজ বেজাবাবু?”
“বটু সর্দার ছাড়া এমন ট্যাটন আর কে?”
স্যাঙাতদের আর-একজন বলে উঠল, “কিন্তু তাকে তো আপনি ভিটেছাড়া করে দিয়েছেন। তার চেলাচামুণ্ডারাও সব ছিটকে ছড়িয়ে গিয়েছে। তার দলবলও নেই, পয়সাও নেই। বয়সও হয়েছে।”
বেজাবাবু গম্ভীর হয়ে ভ্রুকুটি করে বলল, “আর কিছু না থাক, মাথাভরা শয়তানি বুদ্ধি এখনও আছে। আর সেটা যতদিন আছে ততদিন তাকে জব্দ করা সহজ কাজ নয়।”
কেউ কোনও কথা বলল না। বেজাবাবু তার স্যাঙাতদের একজনের দিকে চেয়ে বলল, “শ্যামলাল, গোপালহাটিতে তোর চেনাজানা কে একজন আছে বলছিলি না?”
“হ্যাঁ। রায়বাড়ির সুজয়পদ রায়। পালোয়ান মানুষ। একসময় নয়াগঞ্জে শচীন তাঁতির আখড়ায় দু’জনেই ডন-বৈঠক করতাম।”
“একটু খোঁজ নিয়ে দ্যাখ তো, বটু গোপালহাটিতেই গা ঢাকা দিয়ে আছে কি না। যত দূর মনে হচ্ছে, আসল নকশাখানা হাতে রেখে বটু একটা জালি নকশা নিতাই আর পানুকে গছিয়েছিল।”
স্যাঙাতদের আর-একজন, নিতান্তই সদ্য গোঁফ গজানো ছোঁকরা বলল, “কিন্তু বেজাবাবু, ধরুন ফস করে যদি বটুসর্দারের সঙ্গে আমাদের কারও মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়, তা হলে কী করতে হবে?”
বেজাবাবু ভ্রুকুটি-কঠিন দৃষ্টিতে ছোঁকরার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল, “সেটাও বলে দিতে হবে? দেখামাত্র এক লহমাও দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালিয়ে দিবি। মুখে আর মাথায়। মনে থাকে যেন, এক লহমাও দেরি করা চলবে না। যদি দু’ সেকেন্ডও দেরি হয়, তা হলেই বটু ছায়া হয়ে যাবে, মায়ার মতো মিলিয়ে যাবে। বটুর পিছনে বহু বছর লেগে থেকেও আজ অবধি আমি বুঝে উঠতে পারিনি, বটু মানুষ না ভূত! কায়া না ছায়া! বুঝেছিস?”
কেদার নামের ছোঁকরাটি বলল, “বুঝলাম। কিন্তু ভয় হল, বটু সর্দারকে কখনও চর্মচক্ষে দেখিনি। বটু মনে করে ভুল লোককে মেরে না দিই।”
“তাতে ক্ষতি নেই। যুদ্ধের সময় কত নিরীহ মানুষও তো মরে। সেটা তো ধর্তব্যের মধ্যে নয়। বটু বলে যাকেই মনে হবে তাকেই গুলি করবি। মনে থাকে যেন, যে বটুকে মারতে পারবে তার জন্য পাঁচ হাজার টাকার ইনাম আমার কবুল করাই আছে।”
ছোঁকরা কেদার গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, বুঝেছে। পরক্ষণেই সে তলচক্ষুতে তার পাশে আর-এক ছোঁকরা ফটিকের দিকে চেয়ে একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসল। ফটিক বাঁ চোখটা একটু ছোট করে মৃদুস্বরে বলল, “চেপে যা।”