“চলুন।” খানিকক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর হঠাৎ গুরুপদ বলে উঠল, “আমার কী মনে হয় জানেন?”
“কী মনে হয়?”
“এরকম যে হবে আপনি তা জানতেন।”
“আরে না না। আমাকে কি সবজান্তা ঠাওরালে বাপু?”
“গুপ্তধনটা হাতছাড়া হল, নকশাটা পর্যন্ত বেহাত হল, কিন্তু আপনার যেন তেমন দুঃখ-টুঃখ হচ্ছে না!”
“দুঃখ হচ্ছে বই কী! বেশ দুঃখ হচ্ছে।”
“আমার এমনও মনে হচ্ছে যে, আপনি ওই লোক দুটোকে চেনেন!”
“শোনো কথা! মানুষ চেনা কি আর সোজা কথা নাকি? এত সহজে মানুষ চেনা গেলে তো ভাবনাই ছিল না।”
“আপনি খুব বিটকেল লোক!”
“তা তো বটেই! আমি কি কখনও বলেছি যে, আমি লোক ভাল?”
গুরুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে হাঁটতে লাগল।
বাড়িতে এসে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবল গুরুপদ। গুপ্তধনটা হাতের মুঠোয় এসেও এল না! খুনে দু’জন আর-একঘণ্টা পরে এলেও কাজ হয়ে যেত!
শেষ রাতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল গুরুপদ। সকালে উঠে দেখল, বটু সর্দার তার ঘরে বেশ হাসিখুশি মুখে বসে আছে। হাতে সেই বাইবেলখানা আর নকশাটাও। গুরুপদ অবাক হয়ে বলল, “ওগুলো কোথায় পেলেন?”
বটু হেসে কুটিপাটি হয়ে বলল, “সে আর কোয়ো না বাপু! সকালের দিকে চুপিচুপি কাণ্ডখানা দেখতে গিয়ে দেখি, লোক দুটো বেদম হয়ে হেঁদিয়ে পড়ে আছে। সারারাত খোঁড়াখুঁড়ি করেছে তো! জিনিসও তুলেছে সেথা। একপাঁজা চিনেমাটির বাসন, দুটো বড় বড় লোহার গামলা, গোটাদুই কেঠো চেয়ার, একটা মরচে পড়া গাদাবন্দুক, আতশ কাঁচ, চাবির গোছা, পোড়ামাটির পুতুল, আরও কী সব যেন। তা অত খাটুনিতে দু’জনেই নেতিয়ে পড়েছিল। আমি গিয়ে বাইবেল আর নকশাখানা তুলে নিয়ে এলাম।”
গুরুপদ নাক সিঁটকে বলল, “ওগুলো কেমনধারা গুপ্তধন মশাই? কেবল গুচ্ছের থালা-বাটি-গামলা আর ভাঙা বন্দুক! ঘড়া ঘড়া মোহর বেরোবে তবে না! তা ঘড়া-টড়া দেখলেন না কিছু?”
“আহা, ব্যস্ত হচ্ছ কেন? ঘড়াও কি আর না বেরোবে? আরও খোঁড়াখুঁড়ি করতে দাও না, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে’খন।”
গুরুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বেরোলেই আমাদের কোন লবডঙ্কা হবে বলুন! সবই তো ওদের দখলে যাবে।”
বটু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “তা অবিশ্যি ঠিক।”
“না মশাই, আপনার ভাবগতিক আমি ভাল বুঝছি না। ওরা সব সোনাদানা তুলে ফেলছে আর আপনি দিব্যি গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন।”
“ওরে বাপু, ভাল দিকটাও তো দেখতে হবে।”
“এর আবার ভাল দিকটা কী মশাই?”
“একটু তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবে। খোঁড়াখুঁড়ির মেহনতটা তো আর তোমাকে পোয়াতে হচ্ছে না। ওদের উপর দিয়েই যাচ্ছে। সেটা ভাল হচ্ছে না?”
“না, হচ্ছে না। একটা কথা আছে না, পেটে খেলে পিঠে সয়। মেহনতে যদি সাতঘড়া সোনা পাওয়া যায় তা হলে সেটা খারাপ হবে কেন?”
বটু হঠাৎ যেন খুব চিন্তিত হয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তাই তো! এটাও তো ভাববার মতো কথা!”
“তাই তো বলছি। একটু ভাবুন। দরকার হলে আরও দশজন লোক জুটিয়ে আমরা ওদের উপর গিয়ে হামলা করতে পারি।”
বটু আঁতকে উঠে বলল, “ওরে সর্বনাশ! খবরদার ও কাজ করতে যেয়ো না। ওরা দুজনেই খুনেগুন্ডা। দশ-বিশটা লাশ লহমায় ফেলে দেবে।”
ভয় খেয়ে গুরুপদ বলল, “তা হলে কী করব?”
“চুপটি করে থেকেই দ্যাখো না। ওদিককার গর্তটা আরও একটু বড় হতে থাক। তারপর দেখা যাবে।”
তা ঘড়াও শেষ অবধি পাওয়া গেল। একটি-দুটি নয়, পরপর সাত-আটটা ঘড়া এবং পাওয়া গেল প্রাণান্তকর পরিশ্রমের পর, দ্বিতীয় রাত্রির শেষে, ভোরবেলার দিকে। তবে তখন পানু আর নিতাইয়ের দম শেষ, টর্চের আলো নিবুনিবু, শরীর ভেঙে আসছে। দু’ রাত্রি আর-একটা পুরো দিন ধরে মাটি খুঁড়ে ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি উপরে এনে ফেলতে হয়েছে। ঘুমোতে পারেনি ভয়ে, ভাল করে খাওয়া হয়নি। গুপ্তধনের নেশায় তারা পাগলের মতো গর্ত খুঁড়েছে। শেষ অবধি জনসাহেবের শোওয়ার ঘরের নীচে পাওয়া গেল একটা ছোট চোরকুঠুরি। নিবুনিবু টর্চের আলোয় অবশেষে চোখে পড়েছে। মাটির উপরে সাত-সাতটা ঘড়ার মুখ জেগে আছে।
ঘড়া তুলতে গিয়ে তারা টের পেল, শরীরে আর একরত্তিও শক্তি অবশিষ্ট নেই। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। মাথা ঝিমঝিম করছে।
টলতে টলতে কোনও রকমে হেঁচড়ে-হিঁচড়ে দু’জনে উপরে উঠে এল। তারপর মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। বাইরে আলো ফুটেছে, পাখি ডাকছে, সূর্য উঠি-উঠি করতে লেগেছে।
.
কতক্ষণ তারা ঘুমিয়েছে তার হিসেব ছিল না। হঠাৎ একটা হইহই চেঁচামেচি আর বহু লোকের পায়ের শব্দে চমকে দু’জনের ঘুম ভাঙল। দেখল, বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে, চারদিকে ঝলমলে রোদ্দুর। আর সভয়ে দেখতে পেল, পালে-পালে লোক কোদাল, শাবল, গাঁইতি, বস্তা নিয়ে তেড়ে আসছে এদিকেই। অনেকের হাতেই একটা করে কাগজ।
নিতাই চট করে উঠে বসে পিস্তল বের করে গর্জন ছাড়ল, “খবরদার!” তবে গলা ফেঁসে যাওয়ার পর গর্জনটা ফুটল না, একটা ফাসফেসে আওয়াজ বেরোল কেবল।
পিস্তল দেখে লোকগুলো ভয় খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
পানু দুম করে তার পিস্তল থেকে একটা গুলি চালিয়ে দিয়ে বলল, “যে কাছে আসবে সে-ই মরবে।”
একজন মাতব্বর লোক দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল, “তোমরা কারা হে? বাইরের লোক গাঁয়ের এলাকায় ঢুকেছ যে বড়? ডাকাত নাকি?”
নিতাই বলল, “কে বলল ডাকাত? আমরা সরকারি লোক, সার্ভে করতে এসেছি।”