দ্বিতীয় লোকটা সিঁড়িঙ্গে চেহারা। একটু বাবুগোছের। পরনে শান্তিপুরি ধুতি, গায়ে গরদের পাঞ্জাবি। নাক সিঁটকে বলল, “বটু সর্দার, দূর মশাই, এ তো কোনও ভদ্রলোকের নামই নয়।”
গুরুপদ ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে, ভ ভদ্রলোক ননও। তবে গুণী লোক।”
লোকটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “গুণী লোক! মদনপুরের হাটে গুণী লোক ঘাপটি মেরে আছে আর আমি তার খবর জানি না? তা তোমার বটু সর্দারের গুণটা কীসের? ব্যায়ামবীর না মাদারি, হালুইকর না তবলচি, কবিয়াল না দাঁতের ডাক্তার?”
গুরুপদ থতমত খেয়ে বলল, “আজ্ঞে, সেটা ঠিক জানা নেই। তবে গুণী বলেই শোনা ছিল।”
“দূর দূর! শোনা কথায় কান দিয়ো না হে! মদনপুরের হাটে গুণী মানুষ সাকুল্যে তিনজন। হেয়ার কাটিং-এর ফটিক শীল, রসবড়ার কারিগর বিরিঞ্চিপদ পান্ডা আর গনতকার গণেশ গায়েন। বুঝলে?”
গুরুপদ ফাঁপড়ে পড়ল। বলতে নেই, মদনপুরের হাট আড়ে দিঘে বিরাট চত্বর। হাজারও মানুষ গিজগিজ করছে। তল্লাটে এত জমজমাট হাট আর নেই। এখানে বটু সর্দারকে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়।
“ছেলে হারিয়েছে বুঝি?” বলে ভুইফোড় একটা লোক ভারী হাসি-হাসি মুখ করে পথ আটকে দাঁড়িয়ে গেল। ছোঁকরা বয়স, পরনে কালো পাতলুন আর চকরাবকরা জামা, বাবরি চুল আর সরু গোঁফ।
গুরুপদ অবাক হয়ে বলল, “কেমন করে বুঝলেন?”
“ও আমরা মুখ দেখেই বুঝি। ফি হাটবারে এই মদনপুরে না হোক দশ-বিশটা ছেলে-মেয়ে হারায়। মেহনত করে আমরাই তাদের খুঁজে দিই কিনা! ওই তো আমাদের অফিসের সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে, ‘সন্ধানী’। রেটও খুব সস্তা, ছেলেপ্রতি দু’শো টাকা। ছেলের নামধাম, বিবরণ লিখিয়ে একশো টাকা আগাম ফেলে রসিদ পকেটে পুরে নিশ্চিন্তে হাটবাজার করতে থাকুন। দু’ঘণ্টা বাদে আমাদের অফিসে এলেই ছেলে পেয়ে যাবেন।”
“বটে! বাঃ বাঃ, এ তো খুব ভাল ব্যবস্থা!”
“তা আপনার ছেলের নাম কী? বয়স কত? গায়ের রং? হাইট? কোথাও কাটা দাগ বা জডুল আছে কি?”
“ইয়ে, একটা মুশকিল হয়েছে।”
“কী মুশকিল মশাই?”
“আমিও একজনকে খুঁজছি বটে, তবে তার হাইট, বয়স বা জডুলের কথা জানা নেই কিনা!”
“সে কী মশাই? বাপ হয়ে নিজের ছেলের নাম জানেন না?”
“আহা, তা জানব না কেন? ছেলে হলে তবে তো নাম! আর ছেলে হওয়ার আগেও তো কিছু বখেরা থাকে, তাই না? তা আমার যে সেটাও হয়নি?”
“তার মানে?”
“এই বিয়ের কথাই বলছিলাম আর কী! আমার সেটাও হয়ে ওঠেনি কিনা!”
“আহা, সেটা আগে বলবেন তো! তা হলে আপনার হারিয়েছে। কে?”
“তার নাম বটু সর্দার।”
“এই তো মুশকিলে ফেললেন। শুধু নাম দিয়ে কাউকে খুঁজে বের করা ডবল খাটুনির কাজ। ঠিক আছে, আগামটা দিয়ে যান, দেখছি।”
“ওটাও পেরে উঠছি না। একটু আগেই আমার পকেটমার হয়েছে।”
লোকটা কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “যত্ত সব!” তারপর হনহন করে হেঁটে অন্যদিকে চলে গেল। কয়েক পা হেঁটেই দাঁড়াতে হল গুরুপদকে। একটা প্রাণকাড়া গন্ধে ভারী উচাটন হয়ে উঠল সে। কাছেপিঠেই কোথায় যেন ফুলুরি-বেগুনি ভাজা হচ্ছে। তটস্থ হয়ে চারদিকে চেয়েই সে ভিড়টা দেখতে পেল। গন্ধটা যেন বাতাসকে একেবারে রসস্থ করে ফেলেছে। সম্মোহিতের মতো গিয়ে ভিড়ের পিছন দিকটায় দাঁড়িয়ে প্রাণভরে গন্ধটা নিল সে। পকেটে পয়সা না থাকলে দুঃখের জল যে কোথা থেকে কোথায় গড়াতে পারে, তা আজ হাড়ে-হাড়ে বুঝল সে। পণ্ডিতরা বলেছেন বটে যে, ঘ্রাণেই অর্ধেক ভোজন হয়ে যায়। কিন্তু গুরুপদর মনে হল, কথাটা বোধ হয় ঠিক নয়। এই তো সে গন্ধে গন্ধে বুকটা ঝাঁঝরা করে ফেলল, কিন্তু কই, পেটটা অর্ধেক ভরেছে বলে তো মনে হচ্ছে না! বরং খিদেটা বেশ চাগাড় দিয়েই উঠতে চাইছে।
“শিবপদ যে!” বলে গোলগাল, বেঁটে আহ্লাদি চেহারার একটা প্যান্ট আর ডোরাকাটা জামাপরা লোক ভারী হাসি হাসি মুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
গুরুপদ বলল, “আমি শিবপদ নই।”
“নও? শিবপদর মতোই যেন লাগল!”
“আপনার চোখের ভুল।”
“তা হবে।” বলে লোকটা বিদেয় হল।
কিন্তু একটু বাদেই চোখে ঘষাকাঁচের চশমা, পায়জামা আর হলুদ পাঞ্জাবি পরা খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা পাকানো চেহারার একটা লোক তার মুখে একটা জর্দা পানের শ্বাস ফেলে বলল, “নব নাকি রে?”
বিরক্ত গুরুপদ একটু রাগের গলায় বলল, “দিলেন তো অমন তেলেভাজার গন্ধটাকে জর্দার গন্ধ দিয়ে গুলিয়ে! আমি নব নই।”
“নও? তা আগে বলতে হয়!” বলে লোকটা ল্যাকপ্যাক করে চলে গেল।
তেলেভাজার খদ্দেরের ভিড় থেকে একটা ছিপছিপে ফরসামতো ছোঁকরা একটা শালপাতার ঠোঙা হাতে বেরিয়ে এসে তার দিকে চেয়ে বলল, “আরে মশাই, যান যান, তাড়াতাড়ি লাইনে ঢুকে পড়ুন। জিনিস শেষ হয়ে আসছে যে!”
গুরুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না হে ভায়া, পকেটে পয়সা নেই।”
ছোঁকরা চটপটে পায়ে চলে যেতে যেতে বলল, “আহা, খুঁজে পেতে দেখুন না, কত সময়ে পাওয়াও তো যায়!”
গুরুপদ বিমর্ষ হয়ে ছোঁকরার গমনপথের দিকে চেয়ে ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্য পকেটে একটু হাত বোলাতে গেল। আর তখনই ভারী অবাক হয়ে টের পেল, তার বুকপকেটে ভাঁজ করা কাগজের মতো কী যেন। সঙ্গে দুটো চাকতিও যেন আঙুলে লাগল। পকেট থেকে জিনিসগুলো বের করে তার মুখ একগাল মাছি। তিনটে দশ টাকার নোট আর দুটো এক টাকার কয়েন! মোট বত্রিশ টাকা। এই টাকাই তো ছিল তার পকেটে? কখন, কীভাবে ফেরত এল রে বাবা? এরকমও কি হয় নাকি? গুরুপদ হাঁ করে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। তা হলে কি তার আদৌ পকেটমার হয়নি?