গুরুপদ দেখল, বহু পুরনো, কীটদষ্ট কাগজটায় একটা আবছা নকশা। বেশ কাঁচা হাতের কাজ। কাগজের উপর পেনসিল দিয়ে লেখা, ‘দি ট্রেজার্স অফ জন আর্চার’। সে উত্তেজিত গলায় বলল, “কোথায় এটা?”
বটু বলল, “ব্যস্ত হোয়য়া না বাপু! জন আর্চারের বাড়ি বেশি দূরে নয়।”
গুরুপদ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলল, “জনসাহেবের কবর! এ সেই জনসাহেবের গুপ্তধন নাকি?”
বটু নির্বিকার গলায় বলল, “তা তো বটেই!”
গুরুপদ নকশাখানা হাতে নিয়ে বেশ ভাল করে খুঁটিয়ে দেখল। কাঁচা হাতের কাজ হলেও নকশাটা বিশেষ জটিল নয়। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। জন আর্চারের বাড়ির দক্ষিণের কোণে বড় শয়নকক্ষের নীচে মাটির তলায় তাঁর সব ধনরত্ন পোঁতা আছে। গুরুপদ সোজা হয়ে বলল, “তা হলে আমরা দেরি করছি কেন?”
বটু সর্দার বলল, “দেরি করছি কে বলল?”
“এক্ষুনি বেরিয়ে পড়লে হয় না?”
“দুর পাগল, দিনে-দুপুরে ওসব করতে গেলে বিপদ! পাঁচজনের নজরে পড়বে। পাঁচটা কথা উঠবে। আজ রাত বারোটার পর দু’জনে বেরোব’খন।”
“কী কী লাগবে?”
“দুখানা শাবল আর একখানা হারিকেন।”
“বড় বস্তা-টস্তা নিতে হবে না?”
বটু অবাক হয়ে বলল, “বস্তা? বস্তা দিয়ে কী হবে?”
“ধনরত্ন ভরে আনতে হবে না?”
বটু মাথা চুলকে বলল, “তা বটে!”
সারাদিনটা ভারী উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেল গুরুপদর।
রাত বারোটার পর জনসাহেবের জঙ্গলে-ঘেরা বাড়ির ধ্বংসস্তূপের সামনে যখন দু’জনে পৌঁছোল, তখন হাড়কাঁপানো শীত আর কুয়াশা। হারিকেনের মলিন আলোয় কিছুই তেমন ঠাহর হওয়ার উপায় নেই।
গুরুপদ বলল, “একটা টর্চ আনলে বড় ভাল হত মশাই!”
“আরে না। গতকাল এসে আমি জায়গাটা আন্দাজ করে গিয়েছি।”
ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে অতিকষ্টে দু’জন পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল। এক জায়গায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে বটু সর্দার হাত তুলে একটা ইশারা করল।
গুরুপদ উত্তেজিত গলায় বলল, “এইটাই কি সেই শোওয়ার ঘর?”
“হুঁ।”
ভাঙা ইট-কাঠ সরিয়ে একটা বিশেষ জায়গায় শাবল মারল বটু। চাপা গলায় বলল, “ওপাশ থেকে তুমিও লেগে পড়ো হে! সময় নেই।”
খুঁড়তে বেশি মেহনত করতে হল না। নরম ঝুরঝুরে মাটি। বটু সর্দার মাঝে-মাঝেই খোঁড়া থামিয়ে উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শোনার চেষ্টা করছে, আর মাঝে-মাঝে পশ্চিমের দিকে তাকাচ্ছে।
গুরুপদর উৎসাহ বেশি। সে প্রবল বিক্রমে মাটি সরাতে সরাতে হঠাৎ চকচকে একটা জিনিস দেখতে পেয়ে সেটা তুলে আনল। বেশ ভারী এবং বহুঁকালের পুরনো একটা মোমদানি।
“এটা কি সোনার জিনিস নাকি মশাই?”
বটু অন্যমনস্ক গলায় বলল, “হতেও পারে!”
গুরুপদ সোৎসাহে খুঁড়তে থাকল আর মাটি সরাতে থাকল। এর পর উঠল একটা রেকাবি, একটা জং-পড়া তলোয়ার। একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া টাকঘড়ি, তামার হাঁড়ি, সোনালি রঙের একটা ক্রুশ, দু’খানা জং-ধরা পিস্তল। গুরুপদর শরীরে দুনো বল এল। সে দ্বিগুণ বেগে খুঁড়তে লেগে গেল।
হঠাৎ বটু বলে উঠল, “আর নয় হে, এবার গা ঢাকা দিতে হচ্ছে।”
“তার মানে? এই তো সবে শুরু।”
“বাপু হে, পণ্ডিতরা বলেছেন, বিপদকালে অর্ধেক ত্যাগ করতে হয়।”
“দূর মশাই, এখনও তো মোহরের কলসি-টলসি ওঠেনি। অর্ধেক ত্যাগ করার কথা ওঠে কীসে?”
বটু কথা না বাড়িয়ে তার নড়া ধরে একটা এ্যাচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, “ছোটো!”
গুরুপদ গাঁইগুই করতে যাচ্ছিল। ঠিক এই সময় পশ্চিম দিক থেকে কড়াৎ করে একটা শব্দ শোনা গেল। একটা গুলি শিসের শব্দ করে পাশের জারুল গাছটার ডালে বিঁধে গেল। গুরুপদর আর আপত্তি হল না। “বাপ রে!” বলে সে বটুর পিছু পিছু ছুটতে লাগল।
ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে একটা অশ্বথগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দু’জনে চেয়ে দেখল, বন্দুক হাতে একটা বেঁটে আর একটা লম্বা ছায়ামূর্তি তাদের ফেলে আসা হারিকেনের আলোয় গর্তটা দেখছে। টর্চ ফেলে চারদিকটাও একটু দেখে নিল তারা।
“ওরা কারা মশাই?”
“তার আমি কী জানি?”
করুণ গলায় গুরুপদ বলল, “গুপ্তধন কি শেষে ওদের হাতেই যাবে মশাই?”
“রকম-সকম দেখে তাই তো মনে হচ্ছে।”
“বাইবেল আর নকশাখানাও যে ওখানে পড়ে রইল?”
বটু বলল, “তা কী আর করা যাবে বলো? বিপদে অর্ধেক ত্যাগ করতে হয়।”
হতাশ গলায় গুরুপদ বলল, “কিন্তু ধর্মত, ন্যায্যত গুপ্তধনটা তো আমাদেরই প্রাপ্য, কী বলেন? আমরাই তো আবিষ্কার করেছি, খোঁড়াখুঁড়ি করেছি।”
“সে তো বটেই। কিন্তু সেকথা ওদের বুঝিয়ে বলা শক্ত হবে।”
“এটা কিন্তু আমাদের উপর খুব জুলুম হচ্ছে! ইস, কত জিনিস তুলে ফেলেছিলাম! আর একটু খুঁড়লেই মোহরের ঘড়াও পাওয়া যেত!”
“হুঁ।”
“না মশাই, আপনার যেন তেমন হেলদোল নেই? সত্যি করে বলুন তো, আপনার আফসোস হচ্ছে না?”
“হচ্ছে না আবার? খুব হচ্ছে! হওয়ারই কথা কিনা!”
হঠাৎ শোনা গেল, দু’জন লোকের একজন একটু চেঁচিয়ে বলে উঠল, “ওরে পানু, এই যে সেই বাইবেল আর গুপ্তধনের নকশা!”
“কই, দেখি দেখি!”
“এটা নিশ্চয়ই ওই বটু শয়তানের কাজ। ও-ই এসেছিল গুপ্তধন উদ্ধার করতে। খুব সময়মতো এসে পড়েছিলাম রে! চারদিকে নজর রাখতে হবে, বুঝলি! বটু বহুত চালাকি জানে। এবার ওকে খতম করতে পারলে তবে শান্তি।”
গুরুপদ শুকনো গলায় বলল, “ওরা যে আপনার কথা বলছে!”
“তাই তো দেখছি! চলো বাপু, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই। শীতটাও চেপে পড়েছে। খোঁড়াখুঁড়ির মেহনতও হয়েছে কম নয়।”