বিজয়পদ বইটা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে উলটে-পালটে দেখে বললেন, “আরে, এই তো সেই বই! হিব্রু ভাষার বাইবেল! এটা আপনি কোথায় পেলেন?”
“আজ্ঞে, যেখানে রাখা ছিল সেখান থেকেই পেয়েছি।”
“বলেন কী? তা বইটা নামিয়েছিলেন কেন?”
“সে আর কবেন না। শুনেছিলুম, বইটার মধ্যে নাকি গুপ্তধনের একখানা নকশা আছে। তা ভাবলুম, নকশাখানা বেহাত হলে বাবুর তো বেজায় লোকসান হয়ে যাবে। তাই নকশাখানা বের করে নিয়ে গিয়ে এই একটু আগে বাজার থেকে ছাপাই করে নিয়ে এলাম।”
বিজয়পদ আঁতকে উঠে বললেন, “জেরক্স করিয়েছেন? সর্বনাশ! তা হলে তো খবরটা চাউর হয়ে যাবে?”
বটু সর্দার চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তা খুব একটা ভুল বলেননি। দোকানি আর তার শাগরেদ বলাবলি করছিল বটে, এটা নাকি গুপ্তধনের নকশা। তা তারাও কয়েকখানা ছাপিয়ে নিল দেখলাম।”
বিজয়বাবু দু হাতে মাথা চেপে ধরে বললেন, “হায়-হায়। সারা গাঁয়ে যে এতক্ষণে ঢিঢ়ি পড়ে যাওয়ার কথা! এমন একটা গোপন জিনিস কি বাজারের দোকানে জেরক্স করতে হয়?”
“ঘাবড়াবেন না বাবু, আসল নকশাটা বইয়ের মধ্যেই যত্ন করে রাখা আছে। হেঁ হেঁ, ওখানা তো আর হাতছাড়া করিনি!”
লখাই এতক্ষণ কথা বলেনি। এবার বলল, “হ্যাঁ বটে, বাজারের পাশ দিয়ে আসার সময় আমি ফটিককে এই নকশার ছাপাই ফিরি করতে দেখেছি। হেঁকে বলছিল বটে, “গুপ্তধনের নকশা, দু’ টাকা! গুপ্তধনের নকশা, দু’ টাকা!”
“কী সর্বনাশ করলেন বলুন তো?”
বটু সর্দার কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “তা বাবু, বুড়ো হয়েছি, ভীমরতিই হল বোধ হয়।”
৫. দিন দুই আগে গুরুপদ
দিন দুই আগে গুরুপদ বলব-বলব করে হঠাৎ বলেই ফেলল, “হ্যাঁ মশাই, আপনি যে পকেটমারি শেখাবেন বলে কথা দিলেন, তা এখন তো দেখছি আপনার মোটেই গা নেই। কেবল খাচ্ছেন দাচ্ছেন, শুয়ে-শুয়ে ঠ্যাং নাচাচ্ছেন, আর আজ না কাল বলে পাশ কাটাচ্ছেন! তা আর কবে শেখাবেন?”
একগাল হেসে বটু সর্দার বলল, “আহা, তাড়াহুড়ো কীসের? তুমি তো বাপু লোকের পকেট মেরে রোজগারপাতি করতে যাচ্ছ না?”
“তা বলে বিদ্যেটা শিখব না মশাই? আমার যে ওইটেই নেশা।”
বটু একটু আনমনা হয়ে বলল, “বৃথা বিদ্যায় কী লাভ বলো তো বাপু? খামোখা শিখে সময় নষ্ট! তার চেয়ে রোজগারপাতি হয়, দুটো টাকা হাতে আসে, এমন কাজই তো ভাল!”
গুরুপদ হতাশ গলায় বলল, “সে আর আমার হওয়ার নয়।” বটু সর্দার সোজা হয়ে বসে হঠাৎ বলল, “তা যদি ফস করে একথোক টাকা তোমার হাতে এসে যায়, তা হলে কী করতে ইচ্ছে যায় তোমার?”
গুরুপদ বিরস মুখে বলল, “সাতমন ঘিও পুড়বে না, আর রাধাও নাচবে না। ওসব ভেবে কী লাভ?”
“আহা ভাবনারও তো একটা সুখ আছে, না কি? মানুষ কি ইচ্ছেমতো সব পায়? খানিকটা পায়, আর খানিকটা ভেবে ভেবে
পূরণ করে নেয়।”
“তা যদি বলেন তা হলে বলতে হয়, হাতে কিছু টাকা পেলে বেশ একটা ঝিনচাক দেখে মোটরবাইক কিনে ফেলতাম। সেইসঙ্গে একটা মনোহারি দোকান খুলে ফেলতাম, আর দেশটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখে আসতাম।”
শুনে খুব হাসল বটু। তারপর অনেকক্ষণ ধরে মাথা নেড়ে-নেড়ে কী ভেবে নিয়ে বলল, “তা সেসব তোমার হয়েই গিয়েছে ধরে নাও। কেল্লা মেরেই দিয়েছ!”
“তার মানে?”
“তোমাকে বলেই বলছি। পাঁচকান কোরো না হে! বলি, গুপ্তধন বলে একটা কথা আছে, শুনেছ কখনও?”
“তা শুনব না কেন?”
“বলি হঠাৎ করে গুপ্তধনই যদি পেয়ে যাও, তা হলে কেমন লাগবে?”
“দূর মশাই, গুপ্তধন-টন পাওয়া কি সোজা নাকি? একশো দেড়শো লটারির টিকিট কিনলাম, তার একটাও লাগল না। আমাদের কি আর সেই কপাল?”
বটু মোটে দমল না। ভারী খুশিয়াল গলায় বলল, “অত হাল ছেড়ে দিয়ো না হে! গুপ্তধনের একটা পাকা খবর আছে বলেই বলছি। কপালটা তোমার বোধ হয় তেমন খারাপ নয়।”
“খবরটা যদি পাকাই হয়, তা হলে আপনি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন কেন? গুপ্তধন তো নিজেই দখল করতে পারতেন?”
বটু উদাস হয়ে বলল, “তা পারতাম। তবে লাভ কী বলো? আমারটা খাবে কে?”
“তার মানে গুপ্তধন পেলে আপনি তার ভাগও চান না?”
একগাল হেসে বটু বলল, “তা চাই না বটে, তবে একজোড়া নতুন জুতো, চুল ছাঁটার পয়সা আর সকালে একদিন ইচ্ছেমতো জিলিপি হলেই চলবে।”
“আপনি বড় গোলমেলে তোক মশাই! খোলসা করে বলুন তো!”
“কথাটা একটু একটু করে ভাঙলে বেশ একটু গা ছমছম ভাব হয়। তাই না?”
“আমার মোটেই তেমনটা হচ্ছে না। ঝেড়ে কাশুন তো মশাই!”
“তোমার তো ওইটাই দোষ! সব ব্যাপারেই তাড়াহুড়ো। ওরে বাপু, কথা জিনিসটা হল বিস্কুটের মতো। অল্প অল্প করে ভেঙে খেতে হয়। তবে না স্বাদ-সোয়াদ টের পাবে। হালুম-খালুম করে গিলতে গেলে যে গলায় আটকায়!”
“আপনি বড়ই গোলমেলে লোক! তখন থেকে ঝোলাচ্ছেন।”
“আচ্ছা আচ্ছা বাপু, বলছি!” বলে বালিশের তলা থেকে একখানা চামড়ার মোটা বই বের করে গুরুপদকে দেখাল বটু।
“ওটা কী?”
“এই হল হিব্রু ভাষায় লেখা একখানা বহু পুরনো বাইবেল।”
“কোথায় পেলেন?”
“যেখানে ছিল সেখানেই পেয়েছি বাপু! অত কথায় কাজ কী?”
“তা বাইবেল দিয়ে হবেটা কী?”
“আহা, ব্যস্ত হচ্ছ কেন? এটা শুধু বাইবেল নয়, সোনার খনি।”
বটু বইখানা খুব সাবধানে খুলে পাতার ভিতর থেকে একটা ভাঁজ করা তুলট কাগজ বের করে আনল। ভারী যত্ন করে কাগজটার ভাঁজ খুলে গুরুপদর সামনে তুলে ধরে বলল, “এবার দ্যাখো।”