চা খেতে খেতে একজন তাকে জিজ্ঞেস করল, “ওহে দোকানি, একজন বুড়োমতো মানুষকে দেখেছ? বছর ষাট-বাষট্টি বয়স, মজবুত চেহারা, খোঁচা-খোঁচা চুল?”
রবি একটু উদাস গলায় বলল, “কত লোকই তো আসছে যাচ্ছে।”
লোকটা ঠান্ডা করে বলল, “ওরে বাপ রে! গোপালহাটি আবার এত তালেবর জায়গা কবে হল যে, বাইরের লোক বেড়াতে আসবে?”
রবি একটু হেসে বলল, “তা গোপালহাটি খুব ফ্যালনা জায়গাও নয়। এখানে নীলকুঠি আছে, পুরনো গির্জা আছে, জনসাহেবের কবর আছে। শুনেছি রাজা কুম্ভের মিনারও ছিল। আগে গোপালহাটিতে লোকে বেড়াতেও এসেছে মশাই।”
বেঁটে লোকটা বলে উঠল, “জনসাহেবের কবর! জনসাহেবটা কে?”
রবি মাথা নেড়ে বলল, “তা জানি না। শুনেছি, সাহেব খুব ভাল মানুষ ছিলেন।”
“এ গাঁয়ের কি আগে অন্য কোনও নাম ছিল দোকানি?”
“ছিল বোধ হয়। আমার ঠাকুরদার আমলে এ গাঁ’কে অনেকে আছাপুর বলত বলে শুনেছি।”
লোক দুটো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বেঁটেজন নিচু গলায় বলল, “আছাপুর মানে আর্চারপুর নয় তো রে নিতাই?”
লম্বাজন অর্থাৎ নিতাইও নিচু গলায় বলল, “হতেই পারে, বোধ হয় গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে নামটা আছাপুর হয়ে গিয়েছে।”
“তা হলে কি ঠিক জায়গাতেই এসেছি বলছিস?”
“অত নিশ্চয়ই করে বলি কী করে বল? বটু সর্দার যদি গন্ধে গন্ধে এখানে এসে থাকে, তবে ধরে নিতে হবে, এটাই সেই জায়গা। আরও একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার। লোকটা তো আর হাওয়া হয়ে যেতে পারে না!”
কথাগুলো এমন নিচু গলায় বলা যে, রবির শুনতে পাওয়ার কথাই নয়। কিন্তু যখন চুরি করত তখন রবি নিজের নাক, কান আর চোখকে সজাগ রাখার বিদ্যে শিখেছিল। লোকের ঠোঁট নড়া দেখে কথা আন্দাজ করতেও সে ছিল ওস্তাদ। নইলে লোকের হাঁড়ির খবর জানবে কী করে?
বেঁটেজন রবির দিকে চেয়ে বলল, “ওহে দোকানি, আমরা যার খোঁজে বেরিয়েছি, তিনি আমার বাবা। একটু মাথার দোষ আছে। হুটহাট মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে যান। একটু ভাল করে ভেবে দ্যাখো তো, মাঝারি লম্বা, বেশ গাট্টাগোট্টা চেহারার ষাট বাষট্টি বছর বয়সি কাঁচা-পাকা খোঁচা-খোঁচা চুলওয়ালা একজন বুড়ো মানুষকে এই অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছ কি না?”
রবি খুব দেখেছে। শুধু দেখাই বা কেন, বটু সর্দারের সঙ্গে গতকালও কত সুখ-দুঃখের কথা হল। একসময় বটুর কাছে কিছুদিন তালিম নিয়েছিল রবি। সেসব কথাও হচ্ছিল। তবে হঠাৎ গোপালহাটিতে তার আগমন কেন সেটা বটু সর্দার ভেঙে বলেনি। রবি জানে যে, বটু মোটে বিয়েই করেনি, তার ছেলেপুলে হওয়ার কথাও ওঠে না।
রবি ভালমানুষের মতো মুখ করে বলল, “এ গাঁয়ে নতুন লোক এলে জানতে পারব না, তা কি হয় মশাই? আপনার বাবা এ গাঁয়ে আসেননি।”
নিতাই বেঁটেজনের দিকে চেয়ে নিচু গলায় বলল, “লোকের কথায় বিশ্বাস নেই রে পানু। হুশিয়ার থেকে নজর রাখতে হবে।”
বেঁটে লোকটা অর্থাৎ পানু ফের রবির দিকে চেয়ে বলল, “আচ্ছা, জনসাহেবের কবরটা কোন দিকে বলতে পারো?”
রবি উদাস গলায় বলল, “বলতে পারব না কেন? এখানেই আমার জন্মকর্ম, এত বছর এখানেই কাটিয়ে দিলাম, আর জনসাহেবের কবর কোথায় তা জানব না?”
“তা তো বটেই হে দোকানি। তা ভাবছিলাম, এসেই যখন পড়া গিয়েছে তখন জনসাহেবের কবরটা একবার দেখেই যাই।”
“তা বেশ তো! গাঁ ছাড়িয়ে পুব দিকে বেশ খানিকটা এগোলে কালিন্দীর জঙ্গল পাবেন। বেশ ঘন জঙ্গল, কাঁটা-ঝোঁপটোপ আছে। সাপখোপও মেলা। ভাঙা গির্জার চাতাল ছাড়িয়ে খানিক এগোলেই ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে জনসাহেবের কবর খুঁজে পাবেন। আজকাল আর কেউ তেমন যায় না বলে আগাছা হয়ে কবর ঢাকা পড়ে গিয়েছে। খুঁজে বের করা শক্ত হবে।”
পানু একটু হেসে বলল, “শক্ত কাজ করতেই আমরা পছন্দ করি। তুমি বেশ ভাল লোক হে দোকানি, অনেক খবর-টবর দিলে।”
রবি ঠোঁট উলটে বলল, “কোথায় আর দিলাম? আপনার
হারানো বাবার খবরই তো দিতে পারলাম না।”
পানু বলল, “বাবার জন্য তেমন চিন্তা নেই। মাথা-পাগলা লোক তো! মাঝে মাঝে হারিয়ে যান বটে, কিছুদিন পর আবার ফিরেও আসেন। তবে যতদূর জানি, এখানে তিনি ঠিকই আসবেন। এলে একটু খবরটা দিয়ে। বাড়ির সবাই বড্ড উচাটন হয়ে আছে।”
“তা খবরটা দেব কোথায়?”
“আমরা আশপাশেই কোথাও থাকব। মাঝে মাঝে এসে খবর নিয়ে যাব’খন।” বলে চায়ের দাম দিয়ে দু’জনেই উঠল। দু’জনের কাঁধেই একটা করে বড়সড় ব্যাগ। রবির অনুমান হল, ওই দু’টির মধ্যে স্লিপিংব্যাগ বা ছোট তাঁবু গোছের কিছু আছে।
বটু সর্দার কী জিনিস দিয়ে তৈরি তা যদি তাকে কেউ জিজ্ঞেস করে, তবে রবি বলতে পারবে না। কখনও মনে হয়, হাওয়া-বাতাস দিয়ে তৈরি। কখনও মনে হয়, স্রেফ রবার। আবার কখনও বা মনে হয়, বুঝি লোহার মুষল। পানু আর নিতাই কেন বটু সর্দারকে খুঁজছে তা রবি অবশ্য জানে না। কিন্তু খুব ভাল উদ্দেশ্যে যে খুঁজছে না, সেটা আন্দাজ করা শক্ত নয়। ভয় হল, বটু সর্দার যতই যোগ-প্রক্রিয়া জানুক, বা যতই বুদ্ধি ধরুক, বন্দুক-পিস্তলের সঙ্গে তো আর পেরে উঠবে না? পানু আর নিতাইয়ের ব্যাগের মধ্যে ওসব জিনিস থাকা বিচিত্র নয়। সেক্ষেত্রে বটু সর্দারের সমূহ বিপদের আশঙ্কা।
দোকান বন্ধ করে রবি বাড়ি যাওয়ার পথে একটু ঘুরে রায়বাড়ির পিছন দিক দিয়ে গিয়ে একটা বিশেষ জানলায় খুব মৃদু তিনটে টোকা দিল। কিছুক্ষণ পর ফের একটা।