ফলে নীচের মহলে রবির নাম ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। বিশ বছর বয়সেই সে দামি সাইকেল কিনে ফেলল। বাড়িতে রেডিয়ো আনল। মাকে গরদের শাড়ি দিয়ে পুজোর সময় প্রণামও করে ফেলল। রবির হাতযশে সকলেই বেশ খুশি। তার তিরিক্ষি মেজাজে বাপ পর্যন্ত তার সঙ্গে হুশিয়ার হয়ে কথা বলতেন।
শুধু তার স্কুলের মাস্টার ব্রজবিলাসবাবু তাকে মাঝে-মাঝে স্মরণ করিয়ে দিতেন, “ওরে রবি, কত বড় একজন মানুষের নামের সঙ্গে তোর নাম জড়িয়ে আছে বাবা, কথাটা কিন্তু ভুলিস না। নামের মর্যাদা রাখিস।”
“তা কী করব মাস্টারমশাই? পদ্য লিখব, না দাড়ি রাখব?”
“আরে না না, ওসব তোকে করতে হবে না। শুধু রবীন্দ্রনাথ নামটা খেয়াল রাখতে বলছি। তুই যে-সে মান্না নোস, রবীন্দ্রনাথ মান্না এটা মনে রাখলেই হবে।”
“তা মা-বাপ যদি আমার একটা ভুল নাম রেখেই থাকেন, তা হলেই বা আমার কী করার আছে বলুন!”
“ওরে, তোকে কিছু করার কথা বলিনি, বরং না-করার কথাই বলছি। রবীন্দ্রনাথ যা-যা করে গিয়েছেন তা যদি না-ও পেরে উঠিস বাবা, তা হলে অন্তত রবীন্দ্রনাথ যা-যা করেননি সেগুলো করতে যাসনি। ওটুকু বুঝে চলতে পারলেই যথেষ্ট।”
কথাটার মধ্যে একটা লাটুর মত প্যাঁচ ছিল। বুদ্ধিমান রবি সেটা ধরতেও পারল। কিন্তু নাম-পুজো করলে যে পেট-পুজোয় টান পড়বে, এটাও তো সত্যি!
এর পর যখন সে বিয়ে করল, তখন তার পিছনে লাগল বউ পটলরানি। রোজ ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, “ওগো, তুমি চুরিটুরি ছেড়ে দাও। ওসব পাপ আর কোরো না। আমি চোরের বউ হয়ে জীবন কাটাতে চাই না। তার চেয়ে ভিক্ষে করা ভাল।”
শুনে ভারী রেগে যেত রবি। বলে কী রে মেয়েটা? সে বুক চিতিয়ে বলত, “আরে। আমি কি হাতা-ন্যাতা চোর নাকি? পাঁচটা গা ঘুরে এসো তো, তল্লাটের সব চোর আমার নাম শুনে কপালে হাত ঠেকায় কি না দেখে এস। আমার কত নামডাক, কত খাতির তা জানো?”
পটলরানি চোখের জল ফেলে বলত, “অমন নামডাকের মুখে ছাই। আমার অমন নামডাকের দরকার নেই। শাক-ভাত, নুন-ভাত খাব, তবু হকের পয়সায় খাব, চুরির পয়সায় নয়।”
দু’-দু’বার রাগ করে পটলরানি বাপের বাড়িও চলে গিয়েছিল। তাও হয়তো রবি চুরি ছাড়ত না। কিন্তু শেষ অবধি বোধ হয় ব্রজবিলাসবাবু আর পটলরানির অভিশাপেই ছাড়তে হল। সে ভারী লজ্জার ঘটনা। এক রাতে যন্ত্রপাতির থলি নিয়ে সবে বেরিয়েছে, এমন সময় পাঁচ-সাতজন মুশকো লোক চারদিক থেকে এসে তাকে জাপটে ধরে বেঁধে ফেলল। তারপর টানতে টানতে শ্মশানেশ্বরী কালীমন্দিরের চাতালে নিয়ে ফেলল। লোকগুলোকে ভালই চেনে রবি। চত্বরের যত চোর আর ডাকাত! রবির হাতযশের ফলে এদের ইদানীং হাঁড়ির হাল হয়েছে। যে বাড়িতেই ঢোকে সেই বাড়িতেই রবি আগে ঢুকে জিনিসপত্র সাফ করে ফেলেছে। তাই সবাই মিলে মিটিং করে ঠিক করেছে, কালীর সামনে রীতিমতো মন্ত্রপাঠ করে তাকে বলি দেবে।
প্রাণের ভয়ে রবি বিস্তর কান্নাকাটি করেছিল। তার যে এমন পরিণতি ঘটতে পারে সেটা সে আন্দাজ করেনি। শেষে জৌ গ্রামের প্রবীণ মানুষ পাঁচুগোপাল মধ্যস্থ হয়ে বলল, “এর বয়স কম, ঘরে কচি বউ আর বিধবা মা আছে। ওর কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে বরং একটা সুযোগ দাও তোমরা। আবার যদি চুরিতে নামে তখন আর ছাড়া হবে না।”
মুচলেকা নয়, তাকে মা কালীর পা ছুঁয়ে শপথ করতে হয়েছিল যে, জীবনে আর চুরি করবে না।
প্রাণে বেঁচে ফিরে এল রবি। পরদিন থেকে আর চুরি করতে বেরোত না। চুরি ছেড়েই দিল সে। কিন্তু কেন ছাড়ল সেটা আর লজ্জায় কারও কাছে প্রকাশ করতে পারত না।
রবি রাতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয় দেখে তার মা বিন্ধ্যবাসিনী আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। একদিন সকালবেলা তাকে ধরে বললেন, “ও বাবা রবি, তুই যে বড় রাতের বেলা নাক ডাকিয়ে ঘুমোস! কাজকর্ম যে লাটে উঠবে বাবা!”
রবি গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি চুরি ছেড়ে দিয়েছি মা!”
বিন্ধ্যবাসিনী বিস্ময়ে হাঁ, “কী সব্বোনেশে কথা! চুরি ছেড়েছিস মানে? তোরা হলি ঝাড়েবংশে চোর। কুলধর্ম ছেড়ে দেওয়া যে মহাপাতক! লক্ষ্মী কুপিতা হবেন, পূর্বপুরুষের আত্মা অভিশাপ দেবে। কুলধর্ম কি ছাড়তে আছে বাবা? বংশমর্যাদার কথাটা কি ভুলে গেলি? শেষে বাপ-দাদার নাম ডোবাবি নাকি হতভাগা? ওসব কথা বলতে নেই বাবা, পাপ হয়!”
বিন্ধ্যবাসিনীকে আর বোঝানোর চেষ্টা করেনি রবি। হাতে যা টাকাপয়সা ছিল আর পটলরানি স্বেচ্ছায় তার গয়না খুলে দেওয়ায় তা দিয়ে সে বাজারে একখানা চা-মিষ্টির দোকান দিল।
দোকান খুব একটা খারাপ চলে না। কষ্টেসৃষ্টে রবির সংসার চলে যায়। বিন্ধ্যবাসিনী রোজই দু ঘণ্টা ধরে নিয়মিত বিলাপ করেন বটে, কিন্তু পটলরানি খুব খুশি।
রবি যে খুব সুখে আছে তা বলা যায় না, তবে অবস্থাটা তাকে মেনে নিতে হয়েছে।
শীতকালে সন্ধের পর দোকানে আর খদ্দের থাকে না। উনুনের পাশটিতে চৌকিতে বসে হ্যারিকেনের আলোয় রবি বিকিকিনির হিসেব লিখছিল। এমন সময় দুটো অচেনা লোক এসে বেঞ্চে বসল।
লম্বামতো লোকটা বলল, “চা হবে?”
রবি বলল, “দুধ নেই। লাল চা হতে পারে।”
“চলবে। খুব গরম দু’কাপ চা দাও তো।”
ফটিক তার কাজের লোক। তাকে দু’কাপ চা করতে বলে রবি আড়চোখে লোক দুটোকে লক্ষ করল। অপরাধ জগতের লোকজন চিনতে তার বড় একটা ভুল হয় না। তবে কিনা সে আজকাল আর সাতে-পাঁচে থাকে না।