শশীমুখীর মুখের উপর কথা কয় এমন সাহস এ বাড়ির কারও নেই। বড়কর্তা অজয়পদ গিন্নির মেজাজ দেখে সুড়সুড় করে বাথরুমের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন। সেজোভাই ব্যায়ামবীর সুজয়পদ মেজদাকে ময়ূরাসন শেখাবে বলে এসেছিল, বড়বউদির মেজাজ দেখে সে আর দাঁড়াল না। সান্ধ্য ব্যায়ামে হাজির হতে ব্যায়ামাগারের দিকে হাঁটা দিল। গন্ধক আর নিশিন্দা মিশিয়ে ধোঁয়া দিলে ভূত-প্রেত পালায় কি না সেটা দেখার জন্য সলিউশনটা একটা কাঁচের পাত্রে নিয়ে এসেছিল অভয়পদ, অবস্থা বেগতিক দেখে সেও পিছু হটে নিজের রসায়নাগারে গিয়ে সেঁধিয়ে পড়ল। ছোট গুরুপদ নানা অপরাধে অপরাধী বলে সাহস করে ঘরে ঢোকেনি। বাইরে বসেই উঁকিঝুঁকি মারছিল। বড়বউদির গলা শুনেই সুট করে সরে পড়ল।
যতীনডাক্তার ব্যাগ গুটিয়ে উঠে পড়ে বললেন, “ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই বউমা। বংশটাও তো দেখতে হবে। ওদের বাপ শিবপদকে দ্যাখোনি? উঠোনে গর্ত করে তার ভিতর সেঁধিয়ে তন্ত্রসাধনা করত। এ বাড়িতে ভূতের পত্তন যদি কেউ করে থাকে, তবে সে-ই করে গিয়েছে। এখন ভূত-প্রেতের আনাগোনা হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। তোমরা বরং বিরিঞ্চিওঝাকে খবর দাও গে!”
ডাক্তার বিদেয় হওয়ার পর মূর্ঘনাদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠলেন। শশীমুখী কিছু মিছে কথা বলেননি। এ বাড়ির লোকগুলো একটু মেনধারা যেন আছে বাপু! তাঁর দেওর সুজয়পদ এমনিতে কিছু খারাপ নয়, কিন্তু তার সারা শরীরে চামড়ার নীচে যেন কিলবিলিয়ে মাগুরমাছ ঘুরে বেড়ায়। মূৰ্ছনাদেবী মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন, “হ্যাঁ রে সুজয়, তোর গায়ে যে সারাদিন মাগুরমাছ ঘঘারে, তোর কাতুকুতু লাগে না?”
হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হেসে সুজয় বলল, “তুমি এর মর্ম কী বুঝবে মেজোবউদি, এ হল গিয়ে মাসল, মাল। এই হল বাইসেপ, এই হল ট্রাইসেপ, এই হল ল্যাটিসমাস আর এই হল সিম প্যাক।” বলে যখন নানা অঙ্গভঙ্গি করে সুজয়পদ আর মাগুরমাছগুলো আরও খলবলিয়ে ওঠে, তখন মূছনাদেবীর মূর্ছা যাওয়ার দশা। কিন্তু গায়ে জোর থাকলেই হবে? বাড়িতে সেদিন চোর আসতেই সুজয়পদ সবার আগে গিয়ে খাটের তলায় সেঁধিয়েছিল। অভয়পদ আর এক কাঠি সরেস। এম এসসি না কি ছাইভস্ম পাশ করে বাড়িতে একখানা রসায়নাগার খুলে নানারকম ওষুধবিষুধ তৈরি করছে দিনরাত। একদিন একটা শিশি হাতে নিয়ে বেরিয়ে সবাইকে দেখাল, এই যে দেখছ, সারাবাড়িতে ছড়িয়ে দিলে একটাও মশা থাকবে না। তা দিল ছড়িয়ে। তাতে মশা গেল কি না বোঝা গেল না, কিন্তু মাছির উৎপাতে সবাই অতিষ্ঠ। শুয়োপোকা তাড়াতে শিউলি গাছে ওষুধ দিয়েছিল। তাতে শুয়োপোকার সঙ্গে গাছটাও গেল মরে!
ছোট দেওর গুরুপদরও গুণের ঘাটতি নেই। পড়াশোনা গোল্লায় দিয়ে সাপুড়েদের কাছে সাপধরা শিখছে। জাদুকরের কাছে শিখছে জাদুবিদ্যা। কিছুদিন তান্ত্রিকের কাছে তালিম নিয়েছিল, তবলচির কাছে তবলা। যখন যেটা মাথায় চাপে সেটাই শিখতে লেগে যায়। এই তো কয়েকদিন আগে মদনপুরের হাট থেকে একটা বুড়োকে ধরে এনে বাড়িতে তুলেছে।
মূৰ্ছনাদেবী ভারী রেগে গিয়ে বললেন, “ওটা কাকে ধরে আনলি রে হতভাগা?”
একগাল হেসে গুরুপদবলল, “ইনি কত গুণী লোক মেজোবউদি। এঁর একটা ইশকুল আছে।”
মূৰ্ছনাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “স্কুল আছে তো থাক না। এ বাড়িতে এনে জোটালি কী করতে?”
গুরুপদ মাথা চুলকে বলল, “আসলে উনি স্কুলটা এ গাঁয়েই তুলে আনতে চান।”
“ও মা! গোপালহাটিতে সত্যশরণ মেমোরিয়াল স্কুল থাকতে আবার স্কুল কীসের?”
কাঁচুমাচু হয়ে গুরুপদ বলল, “এটা ঠিক ওরকম স্কুল নয় মেজোবউদি। এ হল একটা কারিগরি বিদ্যার স্কুল।”
কারিগরি বিদ্যা-টিদ্যা বোঝেন না মূর্ঘনাদেবী। তবে এটা বোঝেন যে, তার এই ছোট দেওরটিরও মাথার দোষ আছে। আর বুড়ো লোকটাও যেন কেমনধারা! সবসময় জুলজুল করে চারদিকে চেয়ে নজর রাখছে। মূর্ঘনাদেবী মোটেই ভাল বুঝছেন না।
রাতে রান্নাঘরে রুটি বেলতে বসে তিনি শশীমুখীকে বলেই ফেললেন, “বুঝলে দিদি, ওই বটু সর্দার এ বাড়িতে আসার পরই কিন্তু ভূত-প্রেতের উৎপাত শুরু হয়েছে।”
শশীমুখী বললেন, “তাই তো! কথাটা তো আমার খেয়াল হয়নি। প্যাঁড়া, আজই লোকটাকে ঝেটিয়ে তাড়াব।”
মূর্ঘনাদেবী আর্তনাদ করে বললেন, “না না দিদি, ওসব করতে যেয়ো না। ভূত-প্রেত নিয়ে যারা ঘোরে তারা অনেক কিছু করতে পারে। শেষে হিতে বিপরীত হবে যে! তার চেয়ে যাতে মানে-মানে বিদেয় নেয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।”
পাঁচটা গা ঘুরলেও এক সময় রবির মতো পাকা হাতের লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। বাপ-পিতেমোর আমল থেকেই তারা ঝাড়েবংশে চোর। হামা দেওয়া অবস্থা থেকেই তার তালিম শুরু। বাবা চোর, জ্যাঠা চোর, কাকা চোর। চোরে-চোরে ধুল পরিমাণ। তবে দিনেকালে দেখা গেল, রবি তার বাপ-দাদাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। হেন দরজা বা জানলা নেই যা সে লহমায় হাট করে খুলতে পারে না। এমন বাক্স বা লোহার সিন্দুক নেই যা খুলে ফেলতে তার তিন মিনিটের বেশি সময় লাগে। ভাল চোরের আর-একটা লক্ষণ হল, আগাম খবর রাখা। যেমন-তেমন বাড়িতে ঢুকে ছিচকে চুরি করলে খাটুনিতে পোষায় না। রবি কখনও ছোটখাটো কাজ করেনি। তঙ্কে তকে থেকে, নানা সূত্রে খবর নিয়ে বরাবর ঝোঁপ বুঝে কোপ মেরেছে।