“দাঁড়ান, দাঁড়ান, কথাগুলো টুকে রাখি।”
ডান হাতে খালুইভরা মাছ আর বাঁ কাঁধে ফাঁদি জালটা নিয়ে অন্ধকারে ফিরছিল লখাই। জংলা জায়গাটা পেরিয়ে রাস্তায় ওঠার মুখে থমকাল। অন্ধকারটা তার চোখে সয়ে গিয়েছে। দেখল, দুটো লোক দাঁড়িয়ে এদিক পানেই চেয়ে আছে। ভূতের ভয়টা আজকাল মন থেকে উবে গিয়েছে তার। কিন্তু ভয়-ভীতি তো নানারকম আছে। কে জানে কেন, তার বুকটা একটু দুরুদুরু করে উঠল।
হঠাৎ একটা টর্চের জোরালো আলো তার মুখে এসে পড়ল। কে যেন বলে উঠল, “কে রে তুই?”
লখাই ভয় খেয়ে বলল, “আমি লখাই।”
“কে লখাই? চোর-ছ্যাচোড় নাকি রে?”
“আজ্ঞে, না।”
“ধুস! চোর-ছ্যাঁচোড় হলেই বরং আমাদের সুবিধে হত। তা কী মাছ ধরলি রে? চুনো পুঁটি, না রাঘববোয়াল?”
“আজ্ঞে, চুনোপুঁটি।”
“বেশ বেশ! মাছধরা তো খুব ভাল জিনিস। মৎস্য মারিব খাইব সুখে, কী বলিস?”
“যে আজ্ঞে!”
এবার দ্বিতীয় লোকটা দু পা এগিয়ে এসে বলল, “কিছু মনে কোরো না বাপু লখাই, আমরা একটু বিপদে পড়েই এসেছি। আসলে কী জানো, আমাদের বাবা হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। গত দু’দিন ধরে আমরা গায়ে-গাঁয়ে ঘুরে তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। মজবুত চেহারার ষাট-বাষট্টি বছর বয়সের একজন বুড়ো মানুষকে কি দেখেছ? মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। পরনে টাইট করে পরা ধুতি আর গায়ে ফতুয়া?” লখাই সভয়ে মাথা নেড়ে বলল,”আজ্ঞে না।”
“আহা, অত তাড়াহুড়ো করে জবাব দেওয়ার দরকার নেই। একটু ভেবেচিন্তেই হয় বললে!”
“গায়ে লোক এলে জানাজানি হয়ে উপায় আছে? না মশাই, উনি এ গাঁয়ে আসেননি।”
“ঠিক আছে। আমরা ঘুরেফিরে আবার আসব’খন। যদি খবর দিতে পারো তো বখশিশ পাবে।”
“যে আজ্ঞে।”
লোক দুটো হেলতে-দুলতে চলে গেল। একটু দূর থেকে শোনা, দু’জনের একজন দিব্যি শিস দিতে দিতে যাচ্ছে। যার বাপ হারায় তার কি শিস দেওয়ার কথা?
বিজয়বাবুর বাড়িতে মাছটা পৌঁছে দিতে গিয়ে আজ তাজ্জব হয়ে গেল লখাই। সেই বুড়ো লোকটা, টাইট ধুতি, খোঁচা চুল, খোঁচা দাড়ি, বিজয়বাবুর পড়ার ঘরে বসে দিব্যি গল্প জুড়ে দিয়েছে যে!
সন্ধেবেলা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে বড় জা শশীমুখী, বিজয়বাবুর গিন্নি মূর্ছনাদেবী, সেজো জা নয়নতারা আর ছোট জা বাসবী আংড়া জ্বেলে তার কাছে বসে আগুন পোয়াতে-পোয়াতে গল্পগাছা করছেন। ঠিক এই সময় বিজয়বাবু হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “ওগো, এককাপ চা পাঠিয়ে দাও শিগগির। অনেকদিন বাদে মৃগাঙ্কদা এসেছেন।”
মূৰ্ছনাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “মৃগাঙ্কা! মৃগাঙ্কদাটা আবার কে?”
“আহা, আমাদের মৃগাঙ্ক সান্ডেল গো। বাবুপাড়ার মৃগাঙ্কদা।”
এবার শশীমুখী অবাক হয়ে বললেন, “তোমার কি মাথা খারাপ হল ঠাকুরপো? মৃগাঙ্ক সান্ডেল আসবে কী করে?”
“কী করে মানে? আসতে নেই নাকি?”
শশীমুখী মুখঝামটা দিয়ে বললেন, “না, নেই! মৃগাঙ্ক সান্ডেল যে দু বছর হল মরেছে!”
“অ্যাঁ!” বলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন বিজয়বাবু। বললেন, “তাই তো! এসব হচ্ছে কী?”
আবার মূৰ্ছার মতো অবস্থা হল। জল এল, পাখা এল। খবর পেয়ে বুড়ো ডাক্তার যতীন পত্রনবিশও এসে হাজির। বুকে নল বসিয়ে, নাড়ি টিপে বিস্তর পরীক্ষা করে বললেন, “এ হয় সিজোফ্রেনিয়া, নয়তো বায়ু থেকে হ্যাঁলুসিনেশন।”
“বায়ু!” কথাটা খুব পছন্দ হল বিজয়বাবুর দাদা অজয় রায়ের। তাঁর পরনে গামছা, হাতে ঘটি। তিনি বললেন, “বায়ু হবে না! কোষ্ঠকাঠিন্য থেকেই তো বায়ু হয়। ডবল ডোজের জোলাপ ঠেসে দিন, বায়ু হাওয়া হয়ে যাবে।”
অজয়বাবুর কাছে কোষ্ঠকাঠিন্য ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনও সমস্যাই নেই। সব রোগ, সব অশান্তি, সব গণ্ডগোলের মূলেই রয়েছে কোষ্ঠকাঠিন্য। এই জন্যই তিনি দিন-রাত হত্তুকি, ত্রিফলা, চিরতা, ইসবগুল খেয়ে থাকেন এবং দিনমানের বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে গামছা পরা অবস্থায় ঘটি হাতে পায়চারি করতে দেখা যায়।
মূর্ঘনাদেবী ঝংকার দিয়ে বললেন, “বায়ু নয় ডাক্তারবাবু, মাথার ব্যামো হয়েছে। তা মাথার ব্যামোর আর দোষ কী? দিন-রাত বই মুখে করে বসে থাকলে ভূত-প্রেত তো দেখবেই।”
শশীমুখী বললেন, “সত্যি কথা বাছা, ওসব ঝুরঝুরে পুরনো বইয়ের মধ্যে ভূত-প্রেতের বাসা হলে আশ্চর্যের কিছু নয়। বইগুলো এবার সেরদরে পতিতপাবনের কাছে বেচে দে মূৰ্ছনা! সব ঠোঙা হয়ে যাক।”
একথা শুনে নির্জীব বিজয়বাবু পট করে উঠে বসলেন। বললেন, “সর্বনাশ! ও কাজও কোরো না! মৃগাঙ্কদা তো সেই কথাই বলতে এসেছিলেন!”
মূর্ঘনাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “কোন কথা?”
বিজয়বাবু খুব চিন্তিতভাবে মূর্ঘনাদেবীর মুখের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বললেন, “বইয়ের কথাই কী যেন বলছিলেন। এখন ঠিক মনে পড়ছে না।”
শশীমুখী রাগ করে বললেন, “সব বাড়িতেই এক-আধটা পাগল থাকে ঠিকই। এই তো পালবুড়ো সারাদিন বিড়বিড় করে বকছে আর কাকে যেন কী দেখাচ্ছে। সামন্তবাড়ির বড়গিন্নি দিনরাত বাড়ির ছেলে-বুড়োকে গোবরজলে নাইয়ে ছাড়ছেন। ঘোষবাড়ির মেয়ে শেফালির বিয়ে হল না বলে সারাদিন বউ সেজে বসে থাকে। তা সে এক-আধটা পাগল তবু সামলানো যায়। কিন্তু এ বাড়ির সব ক’টাই যে পাগল! কেউ কোষ্ঠপাগল, কেউ বইপাগল, কেউ স্বাস্থ্যপাগল, কেউ মিচকেপাগল, আর ছোটজন তো বদ্ধপাগল।”