বিজয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন “তবে আপনি কে?” একগাল হেসে লোকটা বলল, “আমি হলুম একজন লোক।”
শুনে বিজয়বাবু ভারী খুশি। আহ্লাদের গলায় বললেন, “লোক হলেই হবে। লোকেদের মতে ভাল লোক আমি কোথাও দেখিনি।”
লোকটা তাড়াতাড়ি বলল, “আজ্ঞে, নির্যস লোক। তবে ভাল লোক কি না তা বলা ভারী মুশকিল।”
বিজয়বাবু অত্যন্ত উদার গলায় বললেন, “আহা, খারাপটাই বা কী? দিব্যি হাত-পা-মুন্ডু রয়েছে, বাতাসে ফুস করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন না, আর চাই কী? আমার তো কিছু খারাপ মনে হচ্ছে না আপনাকে!”
লোকটা একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, সেটা আমারও মনে হয়। তবে কিনা আমার একটু বদনামও আছে।”
“আহা, সে তো আমারও আছে।” লোকটা ভারী অবাক হয়ে বলল, “আপনার বদনাম? বলেন কী মশাই? আপনার আবার বদনাম কীসের? সাতে নেই, পাঁচে নেই, দিনরাত বই-বোকা হয়ে বসে আছেন, বদনাম হতে যাবে কেন?”
“বইপোকা বললেন নাকি?”
“না। আমি তো বললাম বই-বোকা, আপনি কি পোকা শুনলেন নাকি?”
“সেরকমই যেন মনে হল। তা সে যাকগে। আমারও বেশ বদনাম আছে কিন্তু…!”
“সেটা কীরকম?”
“আচ্ছা, আপনি ‘কোকাই কার্তিক’ কথাটার মানে জানেন?”
“আজ্ঞে, না। আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ!”
“তা হলে ‘ফুস্কামলে’ কাকে বলে তা কি জানা আছে?”
“এই তো মুশকিলে ফেললেন। এসব তো শক্ত-শক্ত কথা!”
“তা হলে অন্তত ‘গোবরগণেশ’টা তো নিশ্চয়ই জানেন?”
লোকটা একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, খুব জানি, খুব।”
“তা লোকে আমাকে কোকাই কার্তিক, ফুস্কামলে এবং গোবরগণেশও বলে থাকে। আমি অবশ্য এসবের মানে জানি না। তবে খুব ভাল কথা বলে মনে হয় না। কী বলেন?”
“আজ্ঞে, আমারও মনে হচ্ছে, এগুলো খুব একটা ভাল কথা নয়।”
“তা ছাড়া লোকে আমাকে ‘জ্ঞানী গেঁড়ে’, “কুমড়োমুখো’, ‘বিদ্যাছাগল’ও বলে থাকে। তবেই বুঝুন, আমারও বদনাম কিছু কম নেই। তা আপনার বদনামটা কোন লাইনে?”
এ কথায় লোকটা ভারী লজ্জা পেয়ে বলল, “সে আর আপনার শুনে কাজ নেই।”
“দেখুন মশাই, আমি শ্রমের মর্যাদা বুঝি। পৃথিবীতে কোনও কাজই ফ্যালনা নয়। সব কাজেরই বিহিত-মর্যাদা আছে, তা চুরি ডাকাতি হলেও।”
“বাঃ, আপনি তো বড় ভাল-ভাল কথা বলেন মশাই? প্রাণটা জল হয়ে গেল! তা আমার বদনামটা ওই লাইনেই। পকেটমারি, চুরি, কেপমারি, এইসব আর কী! তা ধরুন, পেটের দায়ে আমাদের তো বাছাবাছি চলে না। যখন যেটা হয় আর কী!”
“বাঃ, শুনে খুব খুশি হলাম।”
“তা মশাই, আপনার ঘরে যে বই একেবারে গিজগিজ করছে? ঘরখানা কি আপনি ইটের বদলে বই দিয়েই বানিয়েছেন?”
“আরে না না, বইয়ের পিছনে ইটও আছে।”
“আছে? যাক, শুনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল! শুধু বই দিয়ে দেওয়াল গাঁথলে বৃষ্টিবাদলা হলে মুশকিল কিনা! তা এত বই পড়ে কে?”
“কেন, আমিই পড়ি।” লোকটা বড়-বড় চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, “একা?”
“একাই! আমার বাড়িতে আর কেউ তেমন পড়ুয়া নয়।”
“একা এত বই সাপটে ওঠা তো চাট্টিখানি কথা নয় মশাই! আরও দু-চারটে লোক লাগিয়ে দিলে আপনার এত মেহনত করতে হত না। ভাগ-ভাগ করে পড়ে ফেলতেন। দশে মিলি করি কাজ হারি-জিতি নাহি লাজ। তা মশাই, এত লেখাপড়া করতে হচ্ছে কেন আপনাকে? সামনে কি কোনও পাশের পরীক্ষা আছে? গতবার কি পরীক্ষায় ফেল হয়েছিলেন?”
বিজয়বাবু মহা অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে বললেন, “আরে না না, কী মুশকিল, পরীক্ষা-টরিক্ষা নয়। লোকে জানার জন্যই বই পড়ে।”
লোকটা একগাল হেসে বলল, “কী যে বলেন বাবু! বই পড়ে কি কিছু জানা যায়? আমাদের শশধরমাস্টার তো এত বই ঘাঁটে, ঝিঙে আর ধুধুলের বিচির তফাত ধরতে পারল কি?”
কথাটা শুনে বিজয়বাবু ভারী চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাই তো! ঝিঙের বিচি আর ধুধুলের বিচির তফাত তো তাঁরও জানা নেই। সত্যি কথা বলতে কী, বিচি কেন, স্বয়ং ঝিঙে বা ধূধুলকেও তাঁর মনে পড়ল না। অথচ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি ঝিঙে এবং ধুধুলের নাম শুনেছেন এবং সম্ভবত, খেয়েও থাকবেন।
লোকটা জুলজুল করে তাঁর দিকে চেয়ে আছে দেখে বিজয়বাবু একটু বেকায়দায় পড়ে গেলেন। মিনমিন করে বললেন, “ইয়ে, বলছিলাম কী, পৃথিবীতে কত কিছু জানার আছে। তাই না?”
“আছে বই কী! কত কী জানার আছে, তবে কেতাব পড়ে সেসব জানার জো নেই কিনা! ধরুন, ধান আর চিটের তফাত একজন মুখ চাষা লহমায় বুঝে ফেলবে। আপনি সাতশো কেতাব ঘেঁটেও পেরে উঠবেন না।”
এই রে! ধান আর চিটের তফাত যে তিনিও জানেন না! লজ্জা পেয়ে বিজয়বাবু যেন গুটিয়ে ছোট্টটি হয়ে গেলেন। মনে মনে তাঁকে স্বীকার করতে হল যে, এসব জরুরি জিনিস তাঁর জেনে রাখা উচিত ছিল। বই পড়ে তিনি অনেক কিছু জেনেছেন বটে, কিন্তু এখনও জ্ঞানের তেপান্তর সামনে পড়ে আছে। জ্ঞানের দিক থেকে তিনি যে নিতান্তই বেঁটেখাটো একরত্তি একটা মানুষ, এটা আজই প্রথম টের পেলেন তিনি। আমতা আমতা করে বললেন, “তা আপনি বেশ জানেন-শোনেন দেখছি!”
লোকটা ভারী অমায়িক গলায় বলল, “এ আর এমন কী? এই যে কাল রাত্তিরে আপনি ভূত দেখলেন, তা ভূত কী বস্তু দিয়ে তৈরি তা বুঝতে পারলেন কি?”
বিজয়বাবু সাগ্রহে বললেন, “না তো! আপনার জানা আছে নাকি?”
“তা আর জানি না! ফুলের রেণু, প্রজাপতির পাখনা আর মাকড়সার লালা, এই তিন বস্তু মিলিয়ে ভূত তৈরি হয়। ভারী মিহিন জিনিস, হাত দিলে বস্তুটা টেরই পাওয়া যায় না।”