আজ গুরুর ছবির সামনে ধ্যান করতে করতে জরিবাবু যেন স্পষ্টই খৈয়াম খাকে দেখতে পাচ্ছিলেন। এরকম মাঝেমাঝে পান। ধ্যানে কথাবার্তাও হয় তাদের। আজ জরিবাবু ধ্যানে দেখলেন খৈয়াম খাঁ বিকেলে তার বাড়ির সামনের বাগানে পায়চারি করছেন। করতে করতে একটা গোলাপ গাছের সামনে দাঁড়ালেন। গাছটায় অনেক কুঁড়ি হয়েছে, তবে একটা ফোঁটা ফুল নেই। খৈয়াম খ গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজলেন। অমনি ফটাফট কুঁড়িগুলো ফুটে মস্ত মস্ত গোলাপফুল হয়ে হাসতে লাগল। খৈয়াম খাঁ জরিবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “সুর মে রগড়ো, সুর মে মরো। বুঝলি ব্যাটা, সুরের পিছনে অসুরের মতো লেগে থাকতে হয়। সুরই সিঁড়ি, সুরই সড়ক, সুরই সম্পদ। বুঝলি?”
“জি হাঁ, খাঁ সাহেব।”
“রেওয়াজ করতে করতে গলা দিয়ে রক্ত উঠবে, তবু ছাড়বি না। মাথা ঘুরে পড়ে যাবি, ভিরমি খাবি, খিদে পাবে, তবু রেওয়াজ ছেড়ে উঠবি না। আমি একসময়ে দিনে আঠারো ঘণ্টা রেওয়াজ করেছি জানিস?”
“জানি খাঁ সাহেব।”
“তবে শুরু করে দে। সুরে ফুল ফুটিয়ে দিয়ে যা দুনিয়ায়। গান গাইবি এমন যে, মড়ার দেহে পর্যন্ত প্রাণসঞ্চার হয়ে যাবে।”
ভক্তিভরে গুরুদেবকে প্রণাম করে জরিবাবু ধ্যান শেষ করে তানপুরাটা তুলে নিলেন। তারপর পূরবীতে ধরলেন তান। আজ গলায় যেন আলাদা মেজাজ লেগেছে। খুব সুর খেলছে।
চোখ বুজে গাইতে গাইতে হঠাৎ তাঁর গায়ে কাঁটা দিল। কেমন যেন শিরশির করতে লাগল ঘাড়ের কাছটা। তিনি একটা গন্ধ পাচ্ছেন। চেনা গন্ধ নয়। অচেনা গন্ধ। ঠিক বোটকা গন্ধ বলা যায় না বটে, কিন্তু বোঁটকা কথাটাও তো গোলমেলে। বোঁটকা বলতে ঠিক কোন গন্ধটাকে বোঝায়, তাই বা ক’জন বলতে পারে। তার ওপর সব ভূতের গায়ে কি আর একরকমের বোঁটকা গন্ধ হবে? হেরফের হবে না?
গাইতে গাইতেই বড় করে একটা শ্বাস নিলেন। না, কোনও ভুল নেই। একটা অদ্ভুত গন্ধ। সন্দেহ নেই, গানের টানে অদৃশ্যের জগৎ থেকে কেউ একজন এসেছে। একজন? না একাধিক?
চোখ খুলতে ঠিক সাহস হল না জরিবাবুর। মানুষটা তিনি খুব সাহসীও নন। ভূতপ্রেতকে ভয় পান। ভূতেরা তাঁর গান শুনুক এটা তিনি চান বটে, কিন্তু তারা একেবারে চোখের সামনে এসে হাজির হোক এটা তাঁর মোটেই পছন্দ নয়। ভূত ভূতের মতোই থাকবে, আড়ালে-আবডালে। চক্ষুলজ্জা বজায় রেখে।
খুব সাবধানে জরিবাবু তান ছাড়তে ছাড়তে বা চোখ বন্ধ করে রেখে ডান চোখটা সিকিভাগ ফাঁক করলেন। ঘরের মধ্যে সন্ধের অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে উঠেছে। শব্দসাধনা করার জন্য ঘরের জানালা সব কটকটে আঁটা বলে আরও অন্ধকার লাগছে। জরিবাবু তান ছাড়তে ছাড়তে কোনাচে দৃষ্টিতে চারদিকটা দেখার চেষ্টা করলেন। প্রথমটায় কিছু দেখতে পেলেন না। তারপর হঠাৎ চোখে পড়ল দরজার দিকে একটা আবছায়া মূর্তি।
জরিবাবুর গলায় পূরবীতে হঠাৎ কঁপন লাগল।
সে এমন কাঁপন যে, সুরটা পূরবী ছেড়ে হঠাৎ বেসুরো হয়ে তারসপ্তকে চড়ে বসল। কিছুতেই সেখান থেকে নামে না। জরিবাবুর হাত কাঁপতে লাগল, পা কাঁপতে লাগল, গলা কাঁপতে লাগল। এবং তারপর তিনি টের পেলেন গলা দিয়ে সুর নয়, কেবল “ভূ…..ভূ….ভূ শব্দ বেরিয়ে আসছে।
ভূতটা হঠাৎ নড়ে উঠল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “না গো মশাই, হচ্ছে না। গলায় জোয়ারি ছিল ভালই, কিন্তু সুরটা কেটে গেল।”
জরিবাবুর অবশ হাত থেকে তানপুরাটা ঝনাত করে পড়ে গেল। কঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “আর হবে না।”
“কী হবে না?”
“আর কখনও গাইব না।”
“সে কী! গাইবেন না কেন? গান তো ভাল জিনিস। মন ভাল থাকে, ফুসফুস ভাল থাকে, গলায় ব্যায়াম হয়। গাইবেন না কেন। খুব গাইবেন। আমাদের গাঁয়ের করালী ওস্তাদ এমন গান গাইত যে, আশেপাশের সাতটা গাঁয়ে কখনও চোর আসত না। গান ভারি উপকারী জিনিস।”
জরিবাবু কেমন যেন ক্যাবলার মতো খানিক লোকটার দিকে চেয়ে রইলেন। তার মনে হতে লাগল, এই ভূতটা যথার্থ ভূত না হতে পারে। হয়তো চোর।
চোরকেও জরিবাবু যথেষ্ট ভয় পান। গলা-খাঁকারি দিয়ে তিনি একটু ধাতস্থ
হওয়ার চেষ্টা করে বললেন, “আপনি কোনটা?”
‘‘আজ্ঞে, তার মানে?”
“মানে ইয়ে, আপনি ভূত না চোর?”
পঞ্চানন্দ এই কথায় দাঁত বের করে খুব একচোট হাসল। তারপর ঘাড়টাবে চুলকে ভারি লজ্জার ভাব দেখিয়ে বলল, “আজ্ঞে বোধহয় দুটোই।”
“তার মানে?”
“আজ্ঞে ভূতেরা কি কেউ কখনও চোর ছিল না? নাকি চোররাই কেউ কখনও মরে ভূত হয় না?”
“ছিল। হয়।”
“তাহলে? আমি ভূতও বটি, চোরও বটি।”
“দুটোই?”
পঞ্চানন্দ ঘাড় হেলিয়ে নির্বিকার মুখে বলল, “দুটোই। তবু বলি মশাই, সন্দেহও একটু আছে। বছর-কুড়ি আগে ত্রিশূল পর্বত থেকে নামবার সময় বরফের উপর দিয়ে পিছলে তিন হাজার ফুট গভীর এক খাদে পড়ে গিয়েছিলাম। আমারই দোষ। বঙ্কুবাবা বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন, ওরে পঞ্চানন্দ, তোকে যে চৌম্বক খড়মজোড়া দিয়েছি, সেটা ছাড়া কখনও বেরোসনি, পিছলে যাবি। তা তাড়াহুড়োয় সেকথা ভুলে খালিপায়ে বেরিয়ে ওই বিপত্তি। সাতদিন জ্ঞান ছিল না। পরে জ্ঞান-টান ফিরলে, খাদ থেকে হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠেও এলাম। কিন্তু যে আমি উঠে এলাম, সে আসল পঞ্চানন্দ না পঞ্চানন্দর ভূত, তা মাঝে মাঝে ঠিক করতে পারি না মশাই। এমনও হতে পারে যে, খাদে পড়ে আমি অক্কা পেয়েছিলাম আর আমার ভূতটা উঠে এসেছে। আর চোর কি না? মশাই, আমি লুকোব না আপনার কাছে, হাতটার দোষ আমার বহুদিনের।”