ন্যাড়া বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আপনি আমার পিলে চমকে দিয়েছেন।“
লোকটা মাথা চুলকে একটু লজ্জার হাসি হেসে বলল, “তা চমকানো জিনিসটা ভাল। মাঝে-মাঝে চমকালে মানুষের বাড় খুব তাড়াতাড়ি হয়। গাঁয়ের দেশে দেখবে পুকুরে বেড়াজাল ফেলে মাছ ধরা হয়, তারপর ফের সেগুলোকে জলে ফেলে দেওয়া হয়। ওই যে ধরা হয় তাতে মাছ খুব চমকে গিয়ে তাড়াতাড়ি বেড়ে গিয়ে পেল্লায় সাইজের হয়ে দাঁড়ায়।”
ন্যাড়া নিশ্চিন্ত হয়ে তার ডানহাতের বাইসেপটা বাঁ হাত দিয়ে একটু পরীক্ষা করে নিয়ে বলে, “ঠিক কথা তো?”
“আজ্ঞে চারুদত্তর কথা মিথ্যে হয় খুব কম।”
“চারুদত্ত! সে আবার কে?”
“কেন, আমি! নামটা ভাল নয়?”
“এই যে বললেন আপনার নাম দ্বৈপায়ন!”
“বলেছি? বুড়ো বয়সে মাথাটাই গেছে। আমার ঠাকুরদার মাথার দোষ ছিল। রাস্তায় বেরিয়ে যাকে-তাকে কামড়াতেন। সেই দোষটাই বর্তেছে আমার ওপর। না না, ভয় পেয়ো না থোকা। তোমাকে আমি কামড়াব না। আমার নাম দ্বৈপায়নও বটে, চারুদত্তও বটে। আরও কয়েকটা আছে, সব মনে পড়বে ধীরে ধীরে। তা, বলছিলাম কি, শিবুবাবুর যে ছেলে পুলিশে চাকরি করে, সে কোথায়?
“সেজদা! সেজদা তো সেই কুমড়োডাঙায়।”
“অনেকটা দুর নাকি?”
“হ্যাঁ, যেতে দেড় দিন লাগে। চারটে খাল পেরোতে হয়।”
“বাঃ বাঃ। খবরটা ভাল। তা খোকা, তোমাদের বন্দুক-টন্দুক নেই? শিবুবাবুর আমলে কিন্তু ছিল।”
“আছে, কিন্তু ব্যবহার হয় না।”
“খুব ভাল, খুব ভাল, বন্দুক বড় ভাল জিনিসও নয়। ওসব বিদেয় করে দেওয়াই ভাল। তা তুমিই বুঝি কুস্তিগির?”
“হ্যাঁ।”
“বাঃ বেশ। এরকমই চাই। তা সময়মতো দু’একটা প্যাঁচ-টাচ শিখিয়ে দেব’খন।”
“আমি গজ পালোয়ানের কাছে শিখি।”
“গজ পালোয়ান! সে আবার কে?”
“ওই যে চক সাহেবের বাড়িতে যার আখড়া।” কথাটা শুনে লোকটার মুখটা একটু যেন অন্যরকম হয়ে গেল।
০৫.
ন্যাড়াকে আর বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি করল না পঞ্চানন্দ। কয়েক মিনিটেই সে বুঝে নিয়েছে ন্যাড়া কীরকম লোক। তাই সে বলল, “তা বেশ ছোটবাবু, কুস্তিটুস্তি খুব ভালো জিনিস। তুমি বরং তোমার মাসল-টাসল দ্যাখো। পঞ্চানন্দ বেরিয়ে এসে বাড়িটার এদিক-সেদিক সতর্ক পায়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। বলতে নেই বাড়িটা বেশ বড়ই। একতলা দোতলা মিলিয়ে অনেকগুলো ঘর। বড় বড় বারান্দা। চাকর-বাকরদের থাকার জন্যে বাড়ির হাতার মধ্যেই আলাদা ঘর আছে। দেখেশুনে পঞ্চানন্দ খুশিই হল। ঘরদোরের চেকনাই দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এদের বেশ পয়সাকড়ি আছে। এরকমটাই আশা করেছিল সে।
ঘুরতে ঘুরতে একতলার একখানা ঘরে ঢুকে পড়ল পঞ্চানন্দ। সেই ঘরে ওস্তাদ খৈয়াম খয়ের ছবির সামনে জরিবাবু ধ্যান করছিলেন তখন। বিকেলের রেওয়াজ শুরু করার আগে গুরুর ছবির সামনে একটু ধ্যান তিনি রোজই করেন। তারপর তানপুরাটাকে প্রণাম করে তুলে নেন। শুরু হল সুরের খেলা।
খৈয়াম খাঁ লখনউতে থাকেন। রগচটা বুড়ো মানুষ। বিশেষ কাউকে পাত্তা দেন না। যে-সব শিষ্যকে গানবাজনা শেখান, তারা তাকে যমের মতো ডরায়, আবার ভক্তিও করে। তাঁর চেহারাটা দেখবার মতো। বিশাল যমদূতের মতো পাকানো গোঁফ, মাথায় মস্ত পাগড়ি, গায়ে গলাবন্ধ কোট। চেহারাটা রোগাটে হলেও বেশ শক্তপোক্ত। চোখ দুখানা ভীষণ রাগী-রাগী। তার ফোটোর চোখের দিকে তাকালেও একটু ভয়-ভয় করে। শোনা যায় একসময় খৈয়াম খাঁ ডাকাতি করে বেড়াতেন। মানুষ-টানুষ মেরেছেনও মেলা। একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে এক বাড়ির দোতলা থেকে লাফ মারতে গিয়ে ঠ্যাং ভেঙে যায়। ভাঙা ঠ্যাং নিয়েই পালিয়ে যান অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে। তারপর মাস-চারেক পায়ে প্লাস্টার। বেঁধে ঘরে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন সময় কাটানোর জন্য গান ধরেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই গায়ক হয়ে ওঠেন। খৈয়াম খাঁ এতই উঁচুদরের ওস্তাদ যে, সুর দিয়ে তিনি প্রায় যা-খুশি তা-ই করতে পারেন বলে একটা কিংবদন্তি আছে। শক্তি আছে বলে বৈজ্ঞানিকরা বিশ্বাস করেন, তার নাকি সাক্ষাৎ প্রমাণ খৈয়াম খয়ের গান। একদিন নাকি খৈয়াম খাঁ সকালবেলায় তাঁর বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে পোষা পায়রা ওড়াচ্ছিলেন। সেই সময়ে একটা বাজপাখি তার একটা পায়রাকে তাড়া করে। খৈয়াম খাঁ শুধু একটা তান ছুঁড়ে দিলেন আকাশে। সেই শব্দে
বাজপাখিটা কাটা ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে পড়ে গেল। আর একবার একটা বন্ধ দরজার তালা খোলা যাচ্ছিল না। খৈয়াম খা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। শুধু গুনগুন করে ভাঁজলেন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে তালা কড়াত করে খুলে গেল। এমনও শোনা যায়, খৈয়াম খাঁর রেওয়াজের সময় নাকি রাজ্যের ভূত-প্রেত এসে চারদিকে ঘিরে বসে হাঁ করে গান শোনে। তাদের দেখা যায় না বটে, কিন্তু গায়ের বোঁটকা গন্ধ পাওয়া যায়।
এহেন খৈয়াম খাঁর শিষ্য বলেই জরিবাবুরও গানের ওপর অগাধ বিশ্বাস। তিনি জানেন ঠিক মতো ঠিক জায়গায় ঠিক সুর লাগাতে পারলে যে-কোনও অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। প্রায় সময়েই তিনি একটা নেবানো মোমবাতি সামনে নিয়ে বসে রেওয়াজ করেন। কোনওদিন সুরের আগুনে মোমটা দপ করে জ্বলে উঠবে বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। গান গেয়ে তিনি জানালার কাঁচের শার্সি ফাটিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন। জরিবাবু জানেন এই বাড়িতে ভূত আছে। তিনি দেখলেও ঝি-চাকরেরা বহুবার দেখেছে। গান গাওয়ার সময় প্রায় তিনি অনুভব করার যেষ্টা করেন ভূতেরা গান শুনতে এসেছে কি না। আজও তেমন কিছু স্পষ্টভাবে অনুভব করেননি। হয়তো এ-বাড়ির ভূতদের গানে তেমন আগ্রহ নেই। তবে আগ্রহ তিনি জাগিয়ে তুলবেনই। নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে গেলে যে মোমবাতিও জুলবে, শার্সিও ফাটবে এবং ভূতও আসবে, এই বিশ্বাস তার আছে।