ঘরের ছাদের কাছে ক্যাটওয়াকের মতো একটা জায়গায় একজন দানব দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখছে। আংটির সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। কিন্তু দানবটা তাকে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হল না। বাক্সের সামনে মেঝের ওপর লাইটারের মতো জিনিসটা পড়ে আছে। ওটা দিয়ে কী হয় তা জানে না আংটি। কিন্তু মনে হল, কোনও অস্ত্রই হবে। সে যন্ত্রটার দিকে হাত বাড়াল। খুব ধীরে ধীরে। তার চোখ ওপরে দানবটার দিকে।
শেষ মুহূর্তে একটু নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল আংটি। যন্ত্রটা তুলতে গিয়ে একটু দ্রুত হাত বাড়িয়েছিল। সেই নড়াটুকু চোখে পড়ে গেল দানবটার। ওই ওপর থেকে দানবটা এক লাফে নীচে নামল।
আংটি যন্ত্রটা তুলে নিয়ে কিছু না বুঝেই দানবটার দিকে সেটা তাক করে ট্রিগার বা ওই জাতীয় কিছু খুঁজতে লাগল। বুড়ো আঙুলের তলায় আলপিনের
মাথার মতো কিছু একটা অনুভব করে সেটায় প্রাণপণে চাপ দিল সে।
চিড়িক করে একটা শব্দ। বুলেট নয়, অন্য কিছু একটা জিনিস ছুটে গেল দানবটার দিকে। দানব কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ল মেঝের ওপর।
অন্য সব দানবেরা চিৎকার করে ছুটে এল।
আংটি বুঝল, লুকিয়ে থাকা বৃথা। সে বাক্সের ডালাটা খুলে বেরিয়ে এসে যন্ত্রটা আর-একজনের দিকে তাক করল। কিন্তু তার হাত উত্তেজনায় ভয়ে এত কাপছিল যে, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেল সে। অমনি দানবটা একটা হুঙ্কার দিয়ে ঝাঁপ খেল তার ওপর।
দানবের শরীরের চাপে চিড়েচ্যাপ্টাই হয়ে যেত সে। কিন্তু হঠাৎ বিদ্যুতের বেগে আর-একটা লোক যেন শূন্য দিয়ে ভেসে এল। আর তার দুই লোহার হাতে দানবটাকে তুলে অন্য দিকে ছুঁড়ে দিল।
“রামরাহা!” চেঁচিয়ে উঠল আংটি। শেষতম দানবটি দৃশ্যটা দেখে চকিতে তার বেল্ট থেকে একটা জিনিস খুলে আনল। সেটা তাক করল রামরাহার দিকে।
এবার আংটির পালা। এক বানরের লাফে সে দানবের হাত ধরে ঝুলে পড়ল। ঝুল খেয়েই দানবের হাঁটুটায় সে পেল্লায় এক কিক জমিয়ে দিল।
মনঃসংযোগে এই সামান্য ব্যাঘাতই চাইছিল রামরাহা। উড়ন্ত এক বল্লমের মতো সে দানবটার বুকে এসে পড়ল। তারপর দানবটাকে অনায়াসে দু’হাতে তুলে আছড়ে ফেলল সে।
রামরাহা সব ক’জন দানবের শরীর তল্লাশ করে বলল, “কিন্তু গোলকটা কোথায়? সেটা না পেলে তো সব চেষ্টা বৃথা যাবে।”
আংটি আর্তনাদ করে উঠল, “নেই”?
কোথা থেকে ক্ষীণ একটা গলা বলে উঠল, “আছে। এখানে!”
রামরাহা দৌড়ে গেল দেয়ালের কাছে। দেয়ালে কম্বিনেশন লকের মতো গোল চাকতি আর নানা সংকেত! রামরাহা কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে নিয়ে ডিস্কটা ঘোরাতে লাগল। একসময়ে চড়াক করে দেয়ালের গায়ে একটা কুলুঙ্গির ঢাকনা খুলে গেল। তার মধ্যে ঘড়ি। ঘড়ির হাতে গোলক। মুখে হাসি।
রামরাহা গভীর একটা শ্বাস ফেলে পরম নিশ্চিন্তে বলল, “আর ভয় নেই।”
বলাই বাহুল্য, মানুষের মস্ত এক বিপদ ঘটতে-ঘটতেও শেষ অবধি ঘটতে পারেনি। অল্পের জন্য ফঁড়াটা কেটেছে। কিন্তু এ-গল্পের শেষ অবধি কী ঘটল সেটা জানার ইচ্ছে আমাদের হতেই পারে।
রামরাহা খুবই দক্ষতার সঙ্গে সেই গোলকটি ব্যবহার করে দানবদের পুঁতে রাখা চার্জ অকেজো করে দেয়। তার আগেই সে অবশ্য মহাকাশযানটিকে নামিয়ে এনেছিল। নইলে প্রতিশক্তি উৎপাদক গোলকটির প্রভাবে মহাকাশযানের কলকজা অকেজো হয়ে যেত এবং তারা ঝুলে থাকত মহাশূন্যে। দানবদের অন্য চারটি মহাকাশযান, যেগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে যাত্রা করেছিল সেগুলির ভাগ্যে এরকমই ঘটেছিল।
যে কয়েকজন দানব তাদের হাতে ধরা পড়েছিল তাদের দিয়ে রামরাহা মাটির তলা থেকে সমস্ত চার্জ তুলে আনে। তারপর মহাকাশযানে সেগুলি দানবদের সঙ্গেই তুলে দেওয়া হয়। দানবদের জন্য রামরাহা বা আর কেউ কোনও শাস্তির ব্যবস্থা করেনি। কারণ, তা হলে তাদের খুন করতে হয়। দানবরা অবশ্য রামরাহাকে কথা দিয়ে যায় যে, ভবিষ্যতে তারা আর পৃথিবীতে হানা দেবে না।
বিপদমুক্ত পৃথিবীতে প্রথম শ্বাস নিয়েই আংটি পাঁচটি ডিগবাজি খেয়েছিল আনন্দে। ঘড়ি খেল ছয়টি। দেখাদেখি পঞ্চানন্দ দশটি ডিগবাজি খেয়ে ফেলল। হরিবাবুর মনে হল, ডিগবাজি খেলে মস্তিষ্কে একটা নাড়াচাড়ার ফলে জাহাজের সঙ্গে মিল খায় এমন একটা শব্দ মাথায় এসেও যেতে পারে, তিনি পনেরোটা ডিগবাজি খেয়ে গায়ের ব্যথায় সপ্তাহখানেক বিছানায় পড়ে রইলেন।
রামরাহা চক-সাহেবের বাড়িতে আরও কয়েকদিন রইল। আংটি আর ঘড়ি কিছুতেই তাকে সমুদ্রগর্ভে ফিরে যেতে দেবে না। রামরাহা তখন কথা দিল যে, সে আরও কিছুকাল পৃথিবীতে থাকবে। এই গ্রহটা তার খুবই ভাল লাগছে। মাঝে-মাঝে সে ঘড়ি আর আংটির কাছে বেড়াতে আসবে। গোলকটা রামরাহার কাছেই রইল। সে ছাড়া এর মর্ম আর কে বুঝবে?
পঞ্চানন্দ একদিন ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে হরিবাবুকে বলল, “কর্তাবাবু, এবার তো আমাকে ছেড়ে দিতে হয়।”
হরিবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “বলো কী হে, তোমাকে ছাড়লে আমার চলবে কেন?”
“আজ্ঞে, আমি লোক বিশেষ সুবিধের নই। আগেই বলেছিলুম আপনাকে। আমি হলুম গে আসলে গোয়েন্দা।”
হরিবাবু ফের চমকে উঠলেন, “গোয়েন্দা, সর্বনাশ!”
“ঘাবড়াবেন না। গোয়েন্দা শুনলে লোকে ভয় খায় বটে, কিন্তু ভাল লোকদের ভয়ের কিছু নেই। অনেকদিন ধরেই সরকার-বাহাদুর এ-জায়গায় একটা গণ্ডগোলের আঁচ পাচ্ছিলেন। তাই আমাকে পাঠানো হয়েছিল।”