খানিকক্ষণ শুনে রামরাহা বুঝতে পারল, এরা পৃথিবী থেকে কিছু মানুষকে জ্যান্ত অবস্থায় নিজেদের গ্রহে নিয়ে যাচ্ছে নমুনা হিসেবে। এইসব মানুষের হৃৎপিণ্ড, রক্ত, ফুসফুস সব তারা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করবে। দেখবে এদের বেঁচে থাকার পদ্ধতি। এর জন্য কয়েকজন মানুষকে মেরে ফেলতে হবে। বাকিদের জিইয়ে রেখে দেওয়া হবে চিড়িয়াখানার জন্তু হিসেবে।
চ্যাংদোলা করে এনে যে-ঘরটায় দানবেরা তাকে ফেলে দিল, সেটাতে রামরাহা বেশ কয়েকজন মানুষকে দেখতে পেল। যাকে দেখে সে সবচেয়ে খুশি হল, সে আংটি।
আংটি তাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, “রামরাহা!”
রামরাহা হাত বাড়িয়ে বলল, “যন্ত্রটা দাও।”
“যন্ত্র!” বলেই কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল আংটি। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “নেই। কেড়ে নিয়ে গেছে।”
“কী করে কাড়ল?”
“আমি যন্ত্রটায় একটা রঙিন বোম দেখে চেপে দিয়েছিলাম। খুব জোরে। তাতে কিছু হয়নি। কিন্তু হঠাৎ একটা দানব এসে হাজির। আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে যন্ত্রটা কেড়ে নিয়ে গেল এই একটু আগে।”
রামরাহা ঠোঁট কামড়াল।
“কী হবে রামরাহা?”
“দেখা যাক। কাজটা আর সহজ রইল না, এই যা।”
হঠাৎ একজন লোক এগিয়ে এসে রামরাহার মুখের দিকে চেয়ে করুণ স্বরে বলল, “আচ্ছা মশাই, জাহাজের সঙ্গে মেলানো যায়, এমন একটা শব্দ বলতে পারেন?”
রামরাহা অবাক হয়ে বলল, “জাহাজ!”
আংটি বলল, “ইনি আমার বাবা। আমার বাবা একজন কবি।”
“কবি! কবি কাকে বলে?”
“যারা কবিতা লেখে।” রামরাহা মাথা চুলকে বলল, “কবিতা! কিন্তু আমাদের দেশে তো এরকম কোনও জিনিস নেই। কবিতা! কবিতা! কীরকম জিনিস বলো তো!”
হরিবাবু খুব দুঃখের সঙ্গে বললেন, “তা হলে আপনার দেশেরই দুর্ভাগ্য রাহাবাবু। বাঙালি হয়ে কবিতা কাকে বলে জিজ্ঞেস করছেন! আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।”
যে-সময়ে এই নাটক ভিতরে চলছিল, ঠিক সেই সময়ে গজ-পালোয়ান তার অতিকায় চেহারাটা নিয়ে শ্বাপদের মতো এসে পৌঁছল মহাকাশযানের কাছে। একজন দানব মাত্র পাহারায়। বাকিরা রামরাহাকে ভিতরে নিয়ে গেছে, এখনও ফেরেনি।
গজ-পালোয়ান একবার চারদিকটা দেখে নিয়ে নিঃশব্দে কয়েক পা এগিয়ে দাবনটার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল।
দানবটা চকিত পায়ে একটু সরে গিয়েছিল শেষ মুহূর্তে নিজের বিপদ টের পেয়ে। তবে গজকে সম্পূর্ণ এড়াতে পারেনি সে। গজ’র কাঁধের ধাক্কায় সে ছিটকে গেল খানিকটা। তারপর উঠে এসে গজকে দুহাতে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল।
কিন্তু পারবে কেন! গজ’র শক্তি এবং মত্ততা দুই-ই দশ-বিশ গুণ বেড়েছে। উপরন্তু সে তার প্যাঁচ-পয়জারও ভোলেনি। সে দু’হাতে বিপুল দু’খানা ঘুষি চালাল দাবনটার মুখে। দাবনটা টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। গজ তার পা দুখানা ধরে পেল্লায় দুটো পাক মারল মাথার ওপর তুলে। তারপর একটি আছাড়।
কিন্তু আছাড় মারতে গিয়েই দানবটার কেঁচড় থেকে কী একটা ভারী আর শক্ত জিনিস ঠক্ করে গজ’র মাথায় পড়ল।
‘উঃ,” বলে বসে পড়ল গজ।
দানবটা উপুড় হয়ে পড়ে রইল। নড়ল না।
ঘড়ি আর পঞ্চানন্দ এসে গজকে ধরল।
“তোমার কী হল গজদা! দানোটাকে তো আউট করে দিয়েছ।”
পঞ্চানন্দ হাতে টর্চটা জেলে গজ’র মাথাটা দেখে বলল, “এঃ,খুব লেগেছে এখানটায়। কালসিটে দেখা যাচ্ছে। …আরে, ওটা কী?” এই বলে পঞ্চানন্দ মাটি থেকে একটা গোলাকার বস্তু তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল।
ঘড়ি হাত বাড়িয়ে বলল, “দেখি।“
পঞ্চানন্দ হঠাৎ “বাপ রে” বলে আঁতকে উঠে চেঁচাল, “দৌড়ও! আসছে!” কিন্তু সামান্য বে-খেয়ালে যে-ভূল তারা করে ফেলেছিল, তা আর শোধরানো গেল না। চার-পাঁচজন দানো চোখের পলকে ঘিরে ফেলল তাদের।
শেষ চেষ্টা হিসেবে হাতের ভারী বলের মতো বস্তুটা পঞ্চানন্দ প্রাণপণে ছুঁড়ে মারল একজন দানোর মাথা লক্ষ্য করে। কিন্তু দানোটা স্লিপের দক্ষ ফিল্ডারের মতো সেটা লুফে নিল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা একে-একে নিক্ষিপ্ত হল দানোদের মহাকাশ যানের গুপ্ত ঘরে। আংটি চেঁচিয়ে উঠল, “দাদা!”
বড়ছেলে ঘড়িকে দেখে হরিবাবু খুশি হলেন। তবে পঞ্চানন্দকে দেখে তাঁর প্রাণে যেন জল এল। হরিবাবু ভারি খুশি হয়ে বললেন, “পঞ্চানন্দ যে!”
“আজ্ঞে আমিই। যেই শুনলুম আপনাকে এই গাধাগুলো ধরে এনেছে, অমনি আর থাকতে পারলুম না, ছুটে এলুম। তা ভাল তো কর্তাবাবু?”
“ভাল আর কী করে থাকব বলল। জাহাজের সঙ্গে মিল দিয়ে একটা শব্দও যে মাথায় আসছে না। নাগাড়ে ঘণ্টা-দুই ধরে ভাবছি।”
পঞ্চানন্দ একগাল হেসে বলল, “জাহাজ যখন পেয়েছেন, তখন মিলটা আর এমন কী শক্ত জিনিস। হয়ে যাবে’খন।”
“আচ্ছা, মমতাজ শব্দটা কি চলবে হে পঞ্চানন্দ?”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “চলবে, খুব চলবে।”
“কিন্তু একটা অক্ষর যে বেশি হয়ে যাচ্ছে হে।”
“তা হোক। অধিকন্তু ন দোষায়।”
“না হে না, কবিতায় অধিকন্তু চলে না ননও চলে না। দেখি আর একটু ভেবে। সময়টাও কাটাতে হবে।“
এসব কথা যখন চলছে, তখন হঠাৎই একটা শিহরন টের পেল সবাই। তারপর তীব্র একটা বাতাস কাটার শব্দ। একটা ভারহীনতার অনুভূতি।
সবাই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বাক্যহারা হয়ে গেল। রামরাহা আংটির কানে কানে বলল, “আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলেছি। আতঙ্কিত আংটি বলল, “কোথায়?”
“মহাকাশে।” আংটি বোবা হয়ে গেল।
যে গর্ত দিয়ে তাদের ঘরের মধ্যে ফেলা হয়েছে, সেটার দিকে চোখ রেখেছিল রামরাহা। গর্তটার কোনও পাল্লা বা ঢাকনা নেই। একজন দানব ওপরে দাঁড়িয়ে তাদের নজরে রাখছে। তার হাতে একটা খুদে যন্ত্র, অনেকটা। ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মতো। যন্ত্রটা চেনে রামরাহা। ছুঁচের মুখ দিয়ে তরলের পরিবর্তে একটা আলোর রেখা বেরিয়ে আসে। যাকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়, সে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুমিয়ে পড়ে।