আচমকা আলোর রেখাটা একটা পাক খেয়ে বৃত্ত রচনা করল। রামরাহা থমকে দাঁড়াল! এরকম হওয়ার কথা নয়। অজানা এক শক্তির উৎস কেউ ব্যবহার করছে। যদি যন্ত্রটা সক্রিয় হয়ে ওঠে, তবে পৃথিবীর সর্বত্র সবরকম শক্তির উৎস কিছুক্ষণের জন্য অকেজো হয়ে যাবে। বিজলি উৎপন্ন হবে না। পারমাণবিক সংঘাত একরত্তি তাপ দেবে না, থেমে যাবে বেশিরভাগ রি অ্যাকটর।
রামরাহা ভাবতে লাগল, বর্বররা যদি যন্ত্রটার সন্ধান পেয়েই থাকে তবে তারা। এত বোকা নয় যে, এই মোক্ষম সময়ে সেটা ব্যবহার করবে।
তবে? তা হলে?
যন্ত্রটা কে ব্যবহার করছে?
৩২.
দানবের মতো লোকগুলো তাদের দ্রুত ও অতিশয় শক্তিশালী খনক দিয়ে মাটির নীচে যে-সব গর্ত করে ফেলল, সেগুলো বহু মাইল গভীর। খনকগুলোর সঙ্গেই লাগানো রয়েছে চার্জ। বহু দূর থেকে বেতার-তরঙ্গের সঙ্কেতে সেগুলোকে সক্রিয় করা যায়। বিপুল এই উথাল-পাথাল শক্তিতে আলোড়িত হয়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরে উথলে উঠবে। তারপর ভারসাম্য নষ্ট করে কক্ষচ্যুত টালমাটাল করে দেওয়া হবে পৃথিবীকে। সূর্যের বিপুল আকর্ষণ থেকে তার কোনও গ্রহকেই বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। মানুষের বিজ্ঞানে তা একরকম অসম্ভব। কিন্তু পৃথিবী নিজেই যদি মহাকাশযানে পরিণত হয়ে ছুটতে থাকে, তবে তাও সম্ভব। দানবেরা পৃথিবীর গভীরে চার্জ ঢুকিয়ে সেই ব্যবস্থাই করে রাখল। পৃথিবী যখন ছুটতে থাকবে সৌরলোকের বাইরে, তখন এক অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তাকে। কক্ষচ্যুত হলে প্রথম ধাক্কাতেই সমুদ্রে উঠবে বিপুল জলোচ্ছ্বাস, দেখা দেবে প্রবলতম ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত। জীবজগৎ একরকম শেষ হয়ে যাবে তখনই। সৌরলোকের বাইরে পৌঁছলে উবে যাবে পৃথিবীর আবহমণ্ডল, কঠিন বরফের মৃত্যুহিম মোড়কে ঢেকে যাবে চরাচর। গ্রহটি পরে ফের নিজেদের বাসযোগ্য করে নেবে দানবেরা। তবে তখন আর সেটা এই পৃথিবী থাকবে না। এইসব গাছপালা, পাখি, জীবজন্তু, মানুষ, কিছুই না।
রামরাহা হাতের মিটারটার দিকে চেয়ে ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। ছোট্ট কিন্তু বিপুল শক্তির আধার একটি রহস্যময় যন্ত্র এই অদ্ভুত কাণ্ডটি ঘটাচ্ছে। কিংবা যন্ত্রটাকে বলা যায় প্রতিশক্তির আধার। কাছাকাছি যত শক্তির উৎস আছে যন্ত্রটা ঠিক তার বিপরীত ধর্মে কাজ করে যায়। শক্তি ও প্রতিশক্তির সংঘাতে সৃষ্টি হয় একটা নিউট্রাল শূন্যতা। এরকম যন্ত্র রামরাহার অগ্রজ বিজ্ঞানীও আবিষ্কার করতে পারেনি। এই পুরনো আমলের গ্রহে একজন মানুষ কী করে বানাল এরকম জিনিস? তার চেয়েও বড় কথা, এ-যন্ত্র ব্যবহার করাও বড় সহজ নয়। বোধহয় কেউ সত্যিই সেটাকে কাজে লাগাচ্ছে। হয়তো আনাড়ির মতো। কিন্তু ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে যন্ত্রটা অনেক অসম্ভব সম্ভব করবে।
রামরাহার অত্যন্ত হিসেবি মন জীবনে এই প্রথম একটু দ্বিধাগ্রস্ত হল। ইচ্ছে করলে সে এখনই বিপন্ন পৃথিবী থেকে নিজের প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর এক মহাসাগরের তলায় তার মহাকাশযান তৈরি আছে। মাত্র আধঘণ্টার মধ্যেই সেখানে পৌঁছে মহাকাশযানে করে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছেড়ে মহাকাশে পাড়ি দেওয়া সহজ। আর যদি পৃথিবীকে বাঁচাতে চেষ্টা করে, তবে সেই কাজে বিপন্ন হবে তার প্রাণ। শেষ অবধি হয়তো পৃথিবীও বাঁচবে না, সেও নয়। তবে সে যদি ওই যন্ত্রটা হাতে পায়, তা হলে কোনও কথাই নেই।
রামরাহার দ্বিধাটা রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর সে স্থির মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তাকে একটা কাজই করতে হবে। ওই ছোট্ট ছেলেটিকে তার প্রিয়জনসহ কিছুতেই সে মরতে দেবে না। সুতরাং রামরাহাকে ওই দানবদের
আকাশযানে উঠতে হবে। দানবদের হাতে ধরা দিতে হবে।
“জানুস!”
সেই লম্বা লোকটা অবিকল রামরাহার মতোই জলের ওপর দিয়ে ভেসে এগিয়ে এল। রামরাহা তার সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি গা থেকে খুলে লোকটার হাতে দিয়ে বলল, “সেন্টারে গিয়ে অপেক্ষা করো।“
যন্ত্র না থাকায় রামরাহাকে জলে নামতে হবে। সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই। থাকলেও লাভ ছিল না। দানবদের ট্রেসারে তা ধরা পড়ত, এবং ওরা তা কেড়ে নিত।
রামরাহা খুব বোকা মানুষের মতো এগিয়ে গেল।
একজন দানব তাকে দেখে ক্রুদ্ধ এক শব্দ করল। বাকিরা বিদ্যুত-গতিতে ধেয়ে এল তার দিকে।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রামরাহার পক্ষে এই আক্রমণ ঠেকানো মোটেই শক্ত কাজ ছিল না। কিন্তু এখন সে একটুও গায়ের জোর দেখাবে না, তবে সামান্য একটু বাধা দেবে। নইলে ওরা সন্দেহ করতে পারে।
প্রথম যে দানবটা তার দিকে তেড়ে এল, তাকে এড়াতে রামরাহা একটু দৌড়ে পালানোর ভান করল। লোকটা লম্বা হাত বাড়িয়ে খামচে ধরল তার কাঁধ। আর একজন তার দু পা ধরে সটান শূন্যে তুলে ফেলল। তারপর একটা আছাড়।
রামরাহা হাসছিল। দশতলা বাড়ি থেকে সে তো কতদিন স্রেফ লাফ দিয়ে। নেমেছে। তবু সে একটু যন্ত্রণার শব্দ করল। তিন-চারজন দানব এসে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল তাকে। এরা একটা অদ্ভুত ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
রামরাহা চুপ করে কথাগুলো শুনতে লাগল। তার সঙ্গে অনুবাদ্যন্ত্র নেই। কিন্তু বিপুল বিশ্বের অনেক গ্রহে সে ঘুরেছে, ভাষাও শুনেছে হাজার রকম। শব্দ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বিপুল। তাই সে শব্দ ধরে ধরে অর্থে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে লাগল মনে-মনে। তার মাথা টেপরেকর্ডারের মতোই নির্ভুল স্মৃতিশক্তির অধিকারী। যা শেনে বা দ্যাখে, সব হুবহু মনে থাকে।