“বাবা! আমাদের ভীষণ বিপদ।” হরিবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “সে তো বুঝতেই পারছি। যখন জাহাজের সঙ্গে মিল দেওয়ার মতো একটাও শব্দ খুঁজে পেলাম না, তখনই বুঝলাম আমাদের খুব বিপদ ঘটেছে নিশ্চয়ই, তা আর কী করা যাবে, তোদর দুই ভাইয়ের জন্য একটা ক্রিকেট বল রেখেছি। এই নে। বাবার ল্যাবরেটরিতে পেলাম। ভাবলাম তোরা খুব খেলা-টেলা ভালবাসিস, তোদের কাজে লাগবে হয়তো।”
আংটি গোল বস্তুটা হাতে নিয়ে বলল, “কিন্তু বাবা, এ তো ক্রিকেট-বল নয়।”
“তবে এটা কী?”
জিনিসটা হাতে তুলে নিয়ে দেখল আংটি। বেশ ভারী কোনও ধাতু দিয়ে তৈরি। গায়ে খুদে-খুদে বোতামের মতো কী সব রয়েছে। আংটির বুকটা গুড়গুড় করে উঠল। রামরাহা যে জিনিসটার কথা বলেছে, এটা সেটা নয় তো! দাদুর ল্যাবরেটরিতে যখন পাওয়া গেছে, তখন সেটাই হতে পারে। কিন্তু এই বস্তু দিয়ে কী করা যায় তা তো আংটি জানে না। সে জিনিসটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। দেখতে-দেখতে হঠাৎ চোখ পড়ল একটা বোতামের ওপর।
আংটি বোতামটায় হালকা আঙুলে একটা চাপ দিল। কিছুই ঘটল না। আংটি আর একটু জোরে চাপ দিল। কিছুই ঘটল না এবারও।
আংটি একটু ভেবে নিল। তারপর তার শরীরের সমস্ত শক্তি আঙুলে জড়ো করে প্রাণপণে বোতামটা চেপে ধরল।
.
ঘড়ি আর পঞ্চানন্দ সবই দেখছিল। তবে আবছাভাবে।
ঘড়ি মুখ চুন করে বলল, “ওরা বাবাকে ধরেছে, আংটিকেও ধরল, এবার কী করা যায় বলুন তো!”
পঞ্চানন্দ ভয়-খাওয়া মুখে বলল, “আমার মাথায় কিছু খেলছে না। তবে আংটি বড্ড বোকার মতো তেড়েফুঁড়ে গিয়ে বিপাকে পড়ে গেল। একটু বুদ্ধি খাটালে কাজ দিত।”
ঘড়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কিন্তু বুদ্ধি তো মাথায় খেলছে না।”
পঞ্চানন্দ ঘড়ির দেখাদেখি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমার মাথাটা পেটের সঙ্গে বাঁধা। পেট ফাঁকা থাকলে মাথাটাও ফাঁকা হয়ে যায়। আর পেট ভরা থাকলে মাথাটাও নানারকম বুদ্ধি আর ফিকিরে ভরে উঠে। অনেকক্ষণ কিছু খাইনি তো।”
পঞ্চানন্দ কথাটা ভাল করে শেষ করার আগেই তার ঘাড়ে কঁত করে একটা শ্বাস এসে পড়ল। শ্বাস তো নয়, যেন ঘূর্ণিঝড়। পঞ্চানন্দ একটু শিউরে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে যা দেখল তাতে তার বাক্য সরল না। সে হাঁ করে রইল।
ঘড়ি নিবিষ্টমনে জলার মধ্যে দানবদের চলাফেরা লক্ষ্য করছিল। এক্ষুনি একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু এই প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্বল মানুষের কীই বা করার আছে। আচমকা সেও পিছন দিকে একটা কিছুর অস্তিত্ব টের পেল। বিদ্যুৎবেগে ঘাড় ঘুরিয়ে সেও যা দেখল তাতে আঁতকে ওঠারই কথা।
পিছনে বিকট এক চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গজ-পালোয়ান। দু’খানা চোখ জুলজুল করে জ্বলছে। ফুলে-ওঠা শরীরটা যেন খুনখারাপির জন্য উদ্যত হয়ে আছে। হাতের আঙুলগুলো আঁকশির মতো বাঁকা।
ঘড়ি ঘুষি তুলেছিল, কিন্তু সেটা চালাল না। চাপা স্বরে বলল, “গজদা!”
গজ তার দিকে তাকাল। তারপর একটু ভাঙা-গলায় বলল, “তোরা এখানে কী করছিস?”
গজ যে মাতৃভাষায় স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে, এটা ঘড়ি আশা করেনি। সে মনে-মনে ধরে নিয়েছিল, গজ-পালোয়ানও ওই বর্বর দানবদের একজন হয়ে গেছে। কিন্তু তা হয়নি দেখে সে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, “ওই দ্যাখো গজদা, জলার মধ্যে কী সব কাণ্ড হচ্ছে।”
গজ গম্ভীর মুখে বলল, “দেখেছি, আমাকে ওরাই আটকে রেখেছিল ওই গুহায়।”
ঘড়ি আকুল মুখে বলল, “এখন আমরা কী করব গজদা?”
“তোদের কিছু করতে হবে না। আমিই যা করার করছি।” এই বলে গজ-পালোয়ান নিঃশব্দে জলে নেমে গেল। ওই বিশাল দেহ দিয়ে যে কেউ এত সাবলীল চলাফেরা করতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
ঘড়িও টপ করে উঠে পড়ল। কিছু একটা করতে হবে। নইলে সাঙ্ঘাতিক একটা বিপদ ঘটবে। আর একটা কিছু করার এই সুযোগ। সে গজর পিছনে পিছনে এগোতে গিয়ে টের পেল, পঞ্চানন্দ জলে নেমে পড়েছে।
গজর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবশ্য তারা পেরে উঠছিল না। গজ এগিয়ে যাচ্ছে মোটর-লঞ্চের মতো তীব্রবেগে। ঘড়ি আর পঞ্চানন্দ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জল ভেঙে এগোতে লাগল।
.
রামরাহা আংটির আকস্মিক প্রস্থানে একটু থমকে গিয়েছিল। তারপর সে আপনমনে একটু হাসল। স্মিত হাসি। যে জগৎ থেকে সে এসেছে সেখানে কেউ আবেগ বা ভালবাসা দিয়ে চালিত হয় না। তারা চলে হিসেব কষে। প্রতি পদক্ষেপই তাদের মাপা। কিন্তু এ পুরনো আমলের গ্রহটিতে মানুষজনের আচার ব্যবহার সে যত দেখছে তত ভাল লাগছে। তত এরা আকর্ষণ করছে তাকে।
রামরাহা নিজের মহাকাশযানে ফিরে যাবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু এখন তার মনে হল, পৃথিবীর অসহায় এইসব মানুষজনকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা করলে মন্দ হয় না।
রামরাহা ঘাড় ঘুরিয়ে অন্ধকারের দিকে চেয়ে চাপা গলায় বলল, “মাথুস, আমার বি মিটারটা নিয়ে এসো।”
সেই সিঁড়ি লোকটা অন্ধকার কুঁড়ে এগিয়ে এল। হাতে একটা খুব ছোট্ট থার্মোমিটারের মতো জিনিস।
রামরাহা কোমর থেকে বেল্টটা খুলে তার একটা সকেটে মিটারটা ঢুকিয়ে দিল। তারপর বেল্টটা কোমরে পরে নিয়ে সে জলের দিকে পা বাড়াল।
আশ্চর্যের বিষয় জলের দু’ইঞ্চি ওপরে যেন একটা অদৃশ্য কুশলে তার পার পড়ল। তারপর অনায়াসে জলের ওপর দিয়ে সে হাঁটতে লাগল।
হাতের মিটারটার দিকে বারবার চাইছিল রামরাহা। নানারকম আলোর সঙ্কেত ভেসে উঠছে। একটা আলোর রেখা বারবার ঢেউ খেলে যাচ্ছে।