খুবই চিন্তিতভাবে হরিবাবু ফিরে এলেন ঘরে। বাচ্চা চাকরটাকে ডেকে তেল দিয়ে আসতে বললেন। এক টুকরো সাবানও।
হরিবাবুর স্ত্রী এসে বললেন, “লাটসাহেবটি কে?”
“ইয়ে, বাবার বন্ধু।”
“শ্বশুরমশাইয়ের বন্ধু ওইটুকু একটা ছোঁড়া। তোমার মাথাটা গেছে।”
“ঠিক বন্ধু নয়, ওই সাকরেদ ছিল আর কী।”
“তুমি ঠিক জানো, নাকি মুখের কথা শুনে বিশ্বাস করলে?”
হরিবাবু বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন, ”খুব চিনি। ছেলেবেলায় কতবার দেখেছি।”
মিথ্যে কথাটা বলে একটু খারাপও লাগছিল হরিবাবুর। তবে না বললেও চলে না। এ বাড়ির কেউ হরিবাবুর বুদ্ধির ওপর ভরসা রাখে না। কিন্তু হরিবাবু জানেন, মাঝেমধ্যে একটু-আধটু গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেললেও তিনি বোকা লোক নন।
তাঁর স্ত্রী অবশ্য আর উচ্চবাচ্য করলেন না। আপনমনে হরিবাবুর নির্বুদ্ধিতার নানা উদাহরণ দিতে দিতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। হরিবাবু রোদে বসে তেল মাখতে মাখতে হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে আকাশী জামার কথা ভাবতে লাগলেন। আকাশী জামা হাতে পেলে তার ভারি উপকার হত। পৃথিবীর এইসব গণ্ডগোল এড়িয়ে দিব্যি ওপরে গিয়ে বসে কবিতার পর কবিতা লিখে যেতেন।
ভাবতে ভাবতে এমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন যে, তেল-মাখা অবস্থাতেই বসে রইলেন। স্নান-খাওয়ার কথা আর মনেই রইল না। মেঘের বিছানায় বসে, মেঘের বালিশে ঠেস দিয়ে কবিতা লিখতে যে কী ভালই না লাগবে! মাঝে মাঝে মেঘ থেকে আইসক্রিম বানিয়ে খেয়ে নেবেন। তবে তার ভারি সর্দির ধাত, আইসক্রিম সহ্য হবে কি?
কতক্ষণ এইভাবে বসে থাকতেন তা বলা শক্ত। হঠাৎ একটা জোরালো গলা খাকারির শব্দে সচেতন হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, বেশ তেল-চুকচুকে চেহারা। নিয়ে পঞ্চানন দাঁড়িয়ে আছে। গাল-টাল কামানো, ফিটফাট। অমায়িক হেসে বলল, “আজ্ঞে স্নানের পর খাওয়ারও একটা নিয়ম আছে। তা কবিদের বেলায় কি কোনো নিয়মই খাটে না?”
“কেন, নিয়ম খাটবে না কেন?”
“আপনারা সাধারণ মানুষ নন জানি, কিন্তু খিদে তো পাওয়ার কথা। আমাদের গায়ে ভজহরি কবিয়ালকেও দেখেছি, ঝুরিঝুরি কবিতা লিখে ফেলত লহমায়। তারও কাছাকোছার ঠিক থাকত না, এ পথে যেতে ও-পথে চলে যেত, রামকে শ্যাম বলে ভুল করত, ঘোর অমাবস্যায় পূর্ণিমার পদ্য লিখে ফেলত, কিন্তু খিদে পেলে সে একেবারে বক-রাক্ষস। হালুম-খালুম বলে লেগে যেত খাওয়ায়। আপনি যে দেখছি তার চেয়েও ঢের এগিয়ে গেছেন।”
“অ! হ্যাঁ, খাওয়ার একটা ব্যাপার আছে বটে। খিদেও পেয়েছে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না পেটে এ-রকম একটা খুটখাট হচ্ছে কেন।”
“কী রকম বলুন তো? রাতের বেলায় ইঁদুর যেমন খুটখাট করে বেড়ায় সে-রকম তো?”
“হা হা, অনেকটা সে-রকম।”
“তা হলে বলতে নেই আপনার খিদেই পেয়েছে। এবার গা তুলে ফেলুন, নইলে গিন্নিমা আমাদের ব্যবস্থাও করবেন না কিনা। আমারও পেটে ইঁদুরের দৌড়াদৌড়ি লেগে গেছে।”
হবিবাবু খুবই অন্যমনস্কভাবে স্নান-খাওয়া সেরে নিলেন। দুপুরবেলায় বিছানায় আধশোয়া হয়ে পিতলের চাবিটা খুব নিবিষ্টমনে দেখলেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। তার সন্দেহ হতে লাগল, বাবা তাঁর আবিষ্কার করা জিনিসগুলো কোথাও লুকিয়ে রেখে গেছেন। ঈশান কোণে তিন ক্রোশ দূরে কোথাও। সেখানে.এই পিতলের চাবি দিয়ে গুপ্ত দরজা খুলে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে।
হরিবাবু যখন এইসব ভাবছেন তখন অন্যদিকে পঞ্চানন্দ দুপুরের খাওয়া সেরে বাড়ির চাকরের সঙ্গে গল্প জুড়েছে। চাকর কুয়োতলায় বাসন মাজছিল। পঞ্চানন্দ সেখানে গিয়ে ঘাসের ওপর জেঁকে বসে বলল, “ওফ, কত পাল্টে গেছে সব।”
চাকরটা বলল, তা আর বলতে! আগে জলখাবারের জন্য পাঁচখানা রুটি বরাদ্দ ছিল, এখন চারখানা। আগে চিনির চা দিত, আজকাল গুড়ের। আর জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ বাড়লেও বেতন সেই পুরনো রেটে। ওটাই কেবল পাল্টয়নি।”
পঞ্চানন্দ কথাটা কানে না-তুলে বলল, “ত্রিশ বছর আগে যা দেখে গিয়েছিলুম তা আর কিছু নেই। তবে ভূত তিনটে নিশ্চয়ই আছে, না রে?”
‘ভূত! তা থাকতে পারে।”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলে, “আহা, অত হালকাভাবে নিচ্ছিস কেন? যে কোন ভূতের কথা বলছি না। এ হল তিনটে সাহেব-ভূত। তখন তো খুব দাপাদাপি করে বেড়াত।”
চাকর কাজ থামিয়ে হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “সাহেব-ভূত! এ-বাড়িতে ছিল নাকি?”
“থাকবে না মানে! যাবে কোথায়? ওই কেয়াঝোঁপের নীচে মাটির তলায় তাদের লাশ চাপা আছে না?”
“সত্যি বলছ?”
“মিথ্যে বলার কি জো আছে রে? নিজের হাতে পুঁতেছি তাদের। ওই পোঁতার পর থেকেই তাদের এখানে-সেখানে রাত-বিরেতে দেখা যায়। দেখিসনি?”
“আমি মোটে দুমাস হল এসেছি। এখনও দেখিনি।”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলে, “মাঝে-মাঝে দেখা যায় না বটে। বিশেষ করে এই সময়টায় ওরা নিজেদের দেশে বেড়াতে যায়। ফিরে এসেই আবার লাগাবে’খন কুরুক্ষেত্রে।”
“তিনটে সাহেব খুন হল কী করে?”
পঞ্চানন্দ গলা নামিয়ে বলল, “সে অনেক গোপন কথা।”
চাকরটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “সাহেব-ভূতের কথা জানি না, তবে এ বাড়িতে একটা পাহাড়ি ভূত আছে। বেঁটেখাটো মজবুত চেহারা।”
“বলিস কী?”
“কোমরে আই বড় ছোরা। দেখবে’খন যদি থাকো। ওই যে বুড়োকর্তার জাদুইঘর,ওর দাওয়ায় রাত-বিরেতে বসে থাকে এসে।”
কথাটা শুনে পঞ্চানন্দ হঠাৎ যেন কেমন ফ্যাকাসে মেরে গেল।