ডাঙায় তুলে পঞ্চানন্দ আর ঘড়ি ভাল করে গজ-পালোয়ানকে পরীক্ষা করে দেখল। কেউ কিছু বুঝতে পারল না। তবে গজ’র গা থেকে সেই ম ম করা মিষ্টি গন্ধটা পাচ্ছিল ঘড়ি। সে গিয়ে তার ফাঁস-দেওয়া রুমালটা ফের শুঁকল। একই গন্ধ।
পঞ্চানন্দ তার দিকেই চেয়ে ছিল। বলল, “কিছু বুঝতে পারলেন?” ঘড়ি মাথা নেড়ে বলল, “বড্ড ধাঁধা ঠেকছে।”
“রুমালটার মধ্যে কী বেঁধে রেখেছেন?”
“একটা সবুজে কাঁকড়াবিছে। আসল নয়। নকলের।”
পঞ্চানন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, “হুঁ।”
“কিছু বুঝলেন?”
পঞ্চানন্দ দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে না।”
“তা হলে বিজ্ঞের মতো হুঁ বললেন যে?”
পঞ্চানন্দ মৃদু হেসে বলল, “আজ্ঞে আপনি আমাকে খামোখা ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’ করতে লেগেছেন কেন?”
“আগে কথাটার জবাব দিন।”
পঞ্চানন্দ উদাস গলায় বলল, “হুঁ হাঁ লোকে অমন কত বলে, সবসময়ে কারণ থাকে না।”
“আমার কী মনে হয় জানেন? বাইরে থেকে আপনাকে যাই মনে হোক না কেন আপনি আসলে একটি ঘুঘু লোক।”
পঞ্চানন্দ তেমনি উদাসভাবে বলল, “আজ্ঞে আমার তেমন সুনাম নেইও। সবাই ওরকম সব বলে আমার সম্পর্কে। তা ঘুঘুই বোধহয় আমি। কিন্তু এসব কথা পরেও হতে পারবে। ওদিকে কী একটা যেন কাণ্ড হচ্ছে। ওটাও একটু দেখা দরকার।”
“ফ্লাইং সসার তো! আমরাও ওটাই দেখতে বেরিয়েছিলাম। কোন্খানে নামল বলুন তো?”
“বেশি দূর বোধহয় নয়। গজ আপাতত এখানেই থাক। এলাশ তো এখন নড়ানো যাবে না। আমার সঙ্গে আসুন।”
পঞ্চানন্দ চলতে শুরু করল। পিছনে ঘড়ি।
বেশি দূর যেতে হল না। জলার ধারে ঘন ঝোঁপঝাড় ভেদ করে কিছু দূর এগোবার পরই পঞ্চানন্দ দাঁড়িয়ে মাথাটা নামিয়ে ফেলে বলল, “ওই যে। উরে বাবা, এ তো দেখছি রাক্ষস-খোক্কশের বৃত্তান্ত!”
ঘড়িও দেখল। তার মুখে কথা সরল না।
জলার মাঝ বরাবর জলের মধ্যেই একখানা বিশাল চেহারার পটলের মতো বস্তু। দেখতে অনেকটা আদ্যিকালের উড়োজাহাজ জেপলিনের মতো। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে বলে এবং শেষ রাতের দিকে কুয়াশা ভেদ করে স্নান একটু জোৎস্নাও দেখা দিয়েছে বলে বস্তুটা দেখা গেল। কিন্তু উড়ন্ত চাকির চেয়েও বিস্ময়কর হল কয়েকজন দানবাকৃতি জীব সেই মহাকাশযান থেকে কী যেন সব বড়-বড় যন্ত্রপাতি নামাচ্ছে।
পঞ্চানন্দ, চাপা গলায় বলল, “কিছু বুঝলেন?”
“না। এরা কারা?”
পঞ্চানন্দ একটা শ্বাস ফেলে বলল, “এদের আমি আগেও দেখেছি। শিবুবাবুর ল্যাবরেটরি থেকে এরাই গজকে ধরে নিয়ে যায়। খুব সুবিধের লোক বোধহয় এরা নয়। গজও ছিল না।”
“তার মানে? গজদা আবার কী করেছে?”
“সে লম্বা গল্প। শুধু বলে রাখি, গজ এখানে এসে থানা গেড়েছিল একটা মতলবে’ সে মতলব হাসিল হয়েছে কি না জানি না। যদি হয়েও থাকে বেচারা কর্মফলে ফেঁসে গেছে। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কি না।”
“এরা গজদাকে দাদুর ল্যাবরেটরি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তা আপনি জানলেন কী করে? গজদাই বা ওখানে কী করছিল?”
“ফের এক লম্বা গল্পের ফেরে ফেললেন। এখন অত কথার সময় নেই। তবে ঘটনাটা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আপনার দাদুর ল্যাবরেটরিতে সে প্রায়ই ঢুকত। তবে লুকিয়েচুরিয়ে। এবার ঢুকেছিল ন্যাড়াবাবুকে বলে। কিন্তু বেচারার কপালটাই খারাপ।”
“দাদুর ল্যাবরেটরিতে কী আছে?”
“তার আমি কি জানি! আমি মুখ লোক, তিনি পণ্ডিত।” আপনি অনেক কিছুই জানেন। ঘুঘু লোক।”
মাথা চুলকে পঞ্চানন্দ বলল, “আমি একরকম তার হাতেই মানুষ তো। তাই একটু-আধটু জানি বইকী! তবে বেশি নয়।”
ঘড়ি একটু হেসে বলল, “আপনি মোটেই আমার দাদুর হাতে মানুষ নন। আমার সন্দেহ হয় আপনি তাঁকে চিনতেনই না।”
“শিবু হালদার মশাইকে কে না চেনে! প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি।”
“নামে কেউ কেউ চিনতে পারে। কিন্তু আপনি সেরকম লোক নন।”
“আচ্ছা সে-তর্ক পরে হবে’খন। এখন সামনে যা হচ্ছে তার কী করবেন?”
ঘড়ি মাথা নেড়ে বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“কিছু কিন্তু করা উচিত। এই দানবগুলোর মতলব ভাল নয়।” কার্যত অবশ্য কে কী করবে বুঝতে না পেরে চেয়ে রইল।
.
পঞ্চানন্দ লোকটার ওপর হরিবাবুর বেশ আস্থা এসে গেছে। কাজের লোক। হাতে রাখলে মেলা উপকার হবে।
হরিবাবু আজ প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত কবিতা লিখে বায়ু এমন চড়িয়ে ফেলেছেন। যে ঘুম আর আসছে না। ঘরময় পায়চারি করে করে পায়ে ব্যথা হয়ে গেল।
হঠাৎ তার মনে হল, ঘরে হাঁটাহাঁটি না করে প্রাতঃভ্রমণ করে এলে কেমন হয়? প্রাতঃকাল অবশ্য এখনও হয়নি। কিন্তু ভ্রমণ করতে করতে একসময়ে প্রাতঃকাল হবেই। না হয়ে যাবে কোথায়? তা ছাড়া বাইরে এখন বেশ পরিষ্কার বাতাস বইছে, ভাবটাব এসে যেতে পারে। চাই কী নিশুত রাতের ওপর এক খানা কবিতা নামিয়ে ফেলতে পারবেন।
হরিবাবু আর দেরি করলেন না। গা ঢেকে বাঁদুরে টুপি পরে, মোজা জুতো পায়ে দিয়ে তৈরি হয়ে নিলেন। তাঁর মনের মধ্যে কয়েকটা শব্দ ভ্রমরের মতো গুনগুন করছিল। “ঈশান কোণ, তিন ক্রোশ, ঈশান কোণ, তিন ক্রোশ।” প্রথমটায় কথাগুলোকে তার একটা না-লেখা কবিতার লাইন বলে মনে হচ্ছিল। ক্রোশের সঙ্গে কোন্ শব্দটা মেলানো যায় তাও ভাবছিলেন। বোস, তোষ, মোষ, ঘোষ, ফোঁস অনেক শব্দ আসছিল মাথায়। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এটা একটা সংকেত-বাক্য। পঞ্চানন্দ বলেছিল। একটি চাবিও দিয়েছিল বটে।