“চুরি?”
“ওরা অন্য একটা জগতে থাকে। ওদের বাসও এই তোমাদের সৌরমণ্ডলের মতোই একটি কোনও নক্ষত্রের মণ্ডলে। আমার বিশ্বাস, ওদের মণ্ডলে অনেকগুলো গ্রহ জুড়ে ওরা বসবাস করে। সম্ভবত বাসযোগ্য আরও গ্রহ ওদের দরকার।”
আংটি শিউরে উঠে বলে, “ও বাবা! আমার মাথা ঘুরছে।”
মহারাজ মৃদু হেসে বললেন, “ তোমাদের বিজ্ঞান যেখানে আছে, সেখান থেকে ভাবলে এসব প্রায় অবিশ্বাস্যই মনে হয় বটে। তবে আমি যা বলছি, তা তুমি অন্তত অবিশ্বাস কোরো না।”
আংটি নিজের মাথাটা একটু ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে।”
মহারাজ মৃদু হেসে বললেন, “আমার মনে হয় পছন্দমতো একটা গ্রহ খুঁজে বের করতে ওরা মহাকাশে পাড়ি দিয়ে তোমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে। নানাভাবে পরীক্ষা করে ওরা বুঝেছে যে, এরকম একটা গ্রহ হলে ওদের ভালই হয়। এখন কাজ হল পৃথিবীকে ঠেলে নিজেদের নক্ষত্রের মণ্ডলে নিয়ে যাওয়া। ওদের পক্ষে তেমন কিছু শক্ত কাজ নয়।”
আংটি আতঙ্কিত হয়ে বলল, “তা হলে আমাদের কী হবে? এত মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা?”
“সৌরমণ্ডল থেকে ছিটকে গেলে পৃথিবীর উপরিভাগের সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। নষ্ট হয়ে যাবে আবহমণ্ডল! দারুণ ঠাণ্ডায় সব জমে পাথর হয়ে যাবে। ওরা ওদের নক্ষত্রমণ্ডলে নিয়ে গিয়ে পৃথিবীতে আবার আবহমণ্ডল তৈরি করবে। আমার বিশ্বাস, ওরা পৃথিবীকে ওদের কৃষি-গ্রহ হিসেবে ব্যবহার করবে। আমাদের নিজেদের মণ্ডলে আমরাও এক-একটা গ্রহকে এক-এক কাজে ব্যবহার করি।”
আংটি সবিস্ময়ে বলে, “তোমাদের ক’টা গ্রহ আছে?”
“একান্নটা। তাতে আমাদের কুলোয় না। কিন্তু তা বলে আমরা মানুষজন গাছপালা-সহ কোনও গ্রহ চুরির কথা ভাবতেও পারি না। ওরা বর্বর বলেই এরকম নৃশংস কাজ করতে পারে।”
“এখন তা হলে কী হবে?”
মহারাজ চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “সেটাই ভাবছি। বেশ কিছু দিন আগে আমি একটি দুর্ঘটনায় পড়ে তোমাদের পৃথিবীতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হই! আমার মহাকাশযান অকেজো হয়ে গেছে, মেরামত করতে অনেক সময় লাগবে। আমার কাছে এখন তেমন কোনও অস্ত্রশস্ত্র নেই, যা দিয়ে বর্বরদের মোকাবিলা করা যায়।”
আংটি আশান্বিত হয়ে বলল, “কিন্তু আমাদের অ্যাটম বোমা আছে, হাইড্রোজেন বোমা আছে, নাইট্রোজেন বোমা আছে।”
মহারাজ মাথা নেড়ে বললেন, “সেসব আমি জানি। বর্বররাও সব খবর রাখে। তোমাদের কোনও অস্ত্রই কাজে লাগবে না। ওরা সবই সময়মতো অকেজো করে দেবে। পৃথিবীর কোথায় কী আছে, তার সব খবরই ওদের নখদর্পণে। ওরা তোমাদের কোনও সুযোগই দেবে না। আজ ওদের যে মহাকাশযান এসেছে, তাতে কিছু অদ্ভুত যন্ত্রপাতি আছে। এগুলো ওরা ভূগর্ভে পাঠিয়ে দেবে। ওরা নিজেরা মহাকাশযানে উঠে বেশ কিছু দূরে গিয়ে ভূগর্ভের যন্ত্রকে নির্দেশ পাঠাবে। তারপর কী হবে জানো?”
আংটি সভয়ে বলল, “কী হবে?”
“ওই যন্ত্রগুলোর প্রভাবে পৃথিবী নিজেই কক্ষচ্যুত হয়ে ওদের মহাকাশযানের নির্দেশমতো চলতে শুরু করবে এক নির্বাসযাত্রায়।”
“উরেব্বাস!”
“ভয় পেও না। আমি এখনও আছি। এ-ঘটনা এত সহজে ঘটতে দেব না। তবে তোমাদের সাহায্য চাই।”
২৮.
নাড়ি দেখে পঞ্চানন্দ বুঝল, গজ-পালোয়ানের শরীরটা যতই ফুলে উঠুক তার প্রাণের ভয় নেই। তবে জ্ঞান কখন ফিরবে তা বলা যায় না। গজ’র গা থেকে একটা ভারি মিষ্টি গন্ধ আসছে। লোকটাকে এই জলকাদায় এরকম অসহায় অবস্থায় ফেলে যেতে একটু মায়া হল তার। তাই নিচু হয়ে দু বগলের নীচে হাত দিয়ে প্রাণপণে সে শরীরটা টেনে একটু ওপরে তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অত বড় লাশকে নড়ায় কার সাধ্যি? পঞ্চানন্দর গা দিয়ে ঘাম বেরোতে লাগল, ঘনঘন শ্বাস পড়তে লাগল, কোমর টনটন করতে লাগল বৃথা পরিশ্রমে। আচমকাই পিছন থেকে কে যেন তার কাঁধে দুটো টোকা দিল।
পঞ্চানন্দ চমকে একটা লাফ দিয়ে বলে উঠল, “আমি না, আমি কিছু করিনি।”
অন্ধকারে মৃদু একটু হাসি শোনা গেল! কে যেন বলে উঠল, “তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ওই গোরিলাটা তোমার কে হয়?”
পঞ্চানন্দ ঘড়িকে দেখে একগাল হাসবার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসিটা ভাল ফুটল না। মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, বললে পেত্যয় যাবে না, ইটি হল গে আমাদের গজ-পালোয়ান। কিন্তু আঙুল ফুলে কী করে যে কলাগাছ হল সেটিই মাথায় আসছে না।”
বলে পঞ্চানন্দ টর্চটা জ্বেলে গজ-পালোয়ানের মুখে আলো ফেলল।
ঘড়ি একটু ঝুঁকে ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, “অবাক কাণ্ড! এ তো গজদাই। দেখছি। বেঁচে আছে নাকি?”
“আছে আজ্ঞে। নাড়ি চলছে, শ্বাস বইছে, কিন্তু একে কি বেঁচে থাকা বলে? তবে সে চিন্তা পরে। আপাতত গজকে জল থেকে তোলা দরকার।”
ঘড়ি ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবল। ঘটনাটা খুবই বিস্ময়কর। গজ-পালোয়ান এত অল্প সময়ের মধ্যে এরকম পেল্লায় হয়ে উঠল নিশ্চয়ই কোনও কঠিন অসুখে। কিংবা অন্য কোনও রহস্যময় কারণে। ঘড়ি তার হাতে রুমালের পোঁটলাটার দিকে একবার তাকাল। কলের কাঁকড়াবিছেটাকে সে রুমালের ফঁসে আটকে রেখেছে। বিছেটা নড়াচড়া বন্ধ করেছে। তবে মিষ্টি গন্ধটায় এখনও ম ম করছে রুমালটা। ভারি নেশাড়ু গন্ধ। মাথা ঝিমঝিম করে। রুমালটা মাটিতে রেখে সে গজকে তোলার জন্য পঞ্চানন্দর সঙ্গে হাত লাগাল।
কাজটা বড় সহজ হল না। জলকাদায় পা রাখাই দায়। তারপর ওই বিরাট লাশটা টেনে ঢালু বেয়ে তোলা। দুজনেই গলদঘর্ম হয়ে গেল এই শীতের রাতেও।