আংটি যখন এসব ভাবতে-ভাবতে গড়িমসি করছে, তখন লোকটা বলল, “পালানোর কথা ভাবছ?”
আংটি আমতা-আমতা করে বলল, “তা নয় ঠিক।”
“পালালে আমরা কিছুই করব না। যখন আগেরবার পালিয়েছিলে তখন আমরা অনায়াসেই তোমাদের ধরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু মহারাজের সেরকম ইচ্ছে নয়। তাই তোমাদের পালাতে দেখেও আমরা কিছুই করিনি এবারও করব না।
আংটি ভয়ে ভয়ে বলল, “কিন্তু সেবার আপনি আমাদের পিছু নিয়েছিলেন। বাসের মধ্যে আপনাকে কে যেন গুলি করেছিল।”
লোকটা নিরুত্তাপ গলায় বলল, “আমি মোটেই তোমাদের পিছু নিইনি। অন্য একটা জরুরি কাজে মহারাজ আমাকে পাঠিয়েছিলেন। পথে কে বা কারা আমাকে খুন করার চেষ্টা করে।”
“হ্যাঁ, আপনার বুকে গুলি লেগেছিল।”
‘গুলি নয়। তার চেয়ে অনেক মারাত্মক কিছু। কিন্তু আসল কথা, আমি তোমাদের পিছু নিইনি। আজও নেব না। তোমরা বা তোমাদের কারও কোনও ক্ষতি করা মহারাজের উদ্দেশ্য নয়।”
আংটি এই বিপদের মধ্যে যেন একটু ভরসা পেল। লোকটার কথার মধ্যে একটু সত্যও থাকতে পারে।
সে জিজ্ঞেস করল, “উনি কোথাকার মহারাজ?”
“উনি মহারাজ নামে। ইচ্ছে করলে উনি গোটা দুনিয়াটাই সম্রাট হতে পারেন। কিন্তু তেমন ইচ্ছে তাঁর নেই।”
“আপনার বুকে গুলি লাগা সত্ত্বেও আপনি বেঁচে আছেন কী করে?”
“সে সব মহারাজ জানেন। এ পর্যন্ত আমাকে অনেকবারই খুন করবার চেষ্টা হয়েছে। কোনওবারই মরিনি। একটু আগেই কতগুলো বর্বর আমাকে আক্রমণ করেছিল। এতক্ষণ আমার বেঁচে থাকার কথা নয়। তবু দ্যাখো, দিব্যি বেঁচে আছি।”
কথাগুলো আংটি ভাল বুঝতে পারছিল না। খুব হেঁয়ালির মতো লাগছিল। একটু দুরদুরও করছিল বুক। কিন্তু সে প্রাণপণে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। বলল, “মহারাজের কাছে যদি যেতে না চাই, তা হলে সত্যিই উনি কিছু করবেন না?”
‘না। তবে গেলে তোমারই লাভ হবে। অকারণে ভয় পেও না। তোমার। ক্ষতি করতে চাইলে অনায়াসেই করতে পারি। আমার কাছে এমন ওষুধ আছে চোখের পলকে তোমাকে অজ্ঞান করে দেওয়া যায়। এমন অস্ত্র আছে যা দিয়ে। তোমাকে ধুলো করে দেওয়া কিছুই নয়। তবে সেসব আমরা প্রয়োগ করার কথা চিন্তাও করি না।”
আংটি কঁপা গলায় বলল, “ঠিক আছে। মহারাজ কোথায়?”
“আমার সঙ্গে এসো।”
আংটি লোকটার পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
লোকটা কোমরের বোম টিপে জুতোর আলোটা জ্বালিয়ে নিয়েছে। বেশ ফটফটে আলো। এরকম সুন্দর আলোওলা জুতো আংটি কখনও দ্যাখেনি। জুতোর ডগায় দুটি ছোট হেডলাইটের মতো জিনিস বসানো। আলোটা নীলচে এবং তীব্র।
সিঁড়িঙ্গে লোকটা একটা ধ্বংসস্তূপের ওপরে উঠল। স্কুপের ওপরে একটা ড্রাম এমনি পড়ে আছে।
লোকটা ড্রামটাকে দুহাতে ধরে একটা কঁকুনি দিয়ে তুলে ফেলল। তলায় একটা গর্ত।
লোকটা বলল, “নিশ্চিন্তে নামো। কোনও ভয় নেই।”
আংটি একটু ইতস্তত করল। ভয় করছে বটে, কিন্তু ভয় পেলে লাভ নেই। তাই সে দুর্গা’ বলে গর্তের মধ্যে পা বাড়াল।
না, পড়ে গেল না আংটি। গর্তের মধ্যে থাক-থাক-সিঁড়ি। কয়েক ধাপ নামতেই সড়িঙ্গে লোকটাও গর্তের মুখ বন্ধ করে তার পিছু পিছু নেমে এল।
আংটি দেখল, তলাটা অনেকটা সাবওয়ের মতো। একটু নোংরা আর সরু, এই যা, তবে দেখে মনে হয়, এই সাবওয়ে বহুঁকালের পুরনো। বোধহয় এই বাড়ি যখন তৈরি হয়েছিল তখনই চক-সাহেব এই সুড়ঙ্গ বানিয়েছিলেন। আংটি, ঘড়ি এবং তাদের বন্ধুরা বহুবার এ-বাড়িতে এসে চোর-চোর খেলেছে, গুপ্তধনের সন্ধান করেছে। কিন্তু এই সুড়ঙ্গটা কখনও আবিষ্কার করতে পারেনি।
একটু এগোতেই ফের সিঁড়ি। এবার ওপরে ওঠার।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে আংটি যেখানে হাজির হল, সেটা এক বিশাল হলঘর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এরকম ঘর যে এবাড়িতে থাকতে পারে তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না। ঘরে বিজলি বাতির মতো আলো জ্বলছে বটে, কিন্তু খুব মৃদু। ঘরের একধারে কয়েকটা যন্ত্রপাতি রয়েছে। একটা যন্ত্র থেকে অবিরল নানারকম চি চি, কুঁই কুঁই, টরর টরর শব্দ হচ্ছে।
হলঘরের অন্যপ্রান্তে একটা টেবিলের সামনে বসে একজন লোক অখণ্ড মনোযোগে একটা গ্লোব দেখছে। গ্লোবটা নীল কাঁচের মতো জিনিসে তৈরি। তাতে নানারকম আলো।
লোকটাকে চিনতে মোটেই কষ্ট হল না। মহারাজ। মহারাজ আংটির দিকে তাকালেন।
আংটি ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মহারাজ তাকে দেখে হাসলেন। হাসিটা ভারি সুন্দর। রাগ থাকলে এরকম করে কেউ হাসতে পারে না।
মহারাজ ভরাট গলায় বললেন, “এসো আংটি, তোমার জন্যই বসে আছি।” আংটি এক-পা দু-পা করে এগিয়ে গেল। মহারাজের ইঙ্গিতে সিঁড়িঙ্গে লোকটা একটা টুল এগিয়ে দিল।
আংটি মুখোমুখি বসতেই মহারাজ বললেন, “তুমি খুব ভয় পেয়েছ বলে মনে হচ্ছে।”
আংটি বলল, “না, এই একটু…..”
মহারাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে দুঃখ এই যে, পৃথিবীকে কতগুলো বর্বরের হাত থেকে বাঁচানো বোধহয় সম্ভব হবে না। অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু…….”
বলেই মহারাজ তার গোলকের ওপর ঝুঁকে কী একটা দেখতে লাগলেন।
আংটি কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে চেয়ে রইল। মহারাজ ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে বললেন, “খুব তাড়াতাড়ি আমার আর্থ মনিটরটা নিয়ে এসো তো।”
সিঁড়িঙ্গে লোকটা দৌড়ে গিয়ে একটা ক্যালকুলেটরের মতো যন্ত্র নিয়ে এল।