খানিক দূর হেঁটে গিয়ে সে দেখতে পেল, সুড়ঙ্গটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। ঘড়ি এগোতে লাগল। প্রতি মুহূর্তেই ভয় হচ্ছে, কেউ এসে পথে আটকাবে বা আক্রমণ করবে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না।
.
ঘড়ি এসে থামল। প্রকাণ্ড দরবার-ঘরে। চারদিকে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি। কিন্তু কোনও মানুষজন নেই।
ঘড়ি যখন চারদিকে চেয়ে দেখছিল তখন হঠাৎ পায়ের কাছে একটা হঁদুরকলের মতো ছোট্ট বাক্স নজরে পড়ল তার। এমনিতে পড়ত না, কিন্তু বাক্সের ডালাটা আপনা থেকেই খুলে যাচ্ছিল বলে তার চোখ আটকে গেল।
বাক্সের ভিতর থেকে একটা সবুজ কাঁকড়াবিছে বেরিয়ে এল।
ঘড়ি কাঁকড়াবিছে ভালই চেনে। অনেকবার ধরে সুতোয় বেঁধে খেলা করেছে। এক-আধবার হুলও খেয়েছে। কাজেই সে বিশেষ ভয় পেল না। ফট করে এক পা পিছিয়ে গিয়ে ভাল করে দেখল।
কাঁকড়াবিছে সবুজ রঙের হয় কি না তার জানা নেই। তবে সে কখনও। দ্যাখেনি।
বিছেটা তাকে লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসছে, এটা বুঝতে বিশেষ বেগ পেতে হল না ঘড়ির। বাক্সের ডালা আপনা থেকেই খুলে যাওয়া এবং আশ্চর্য সবুজ রঙের বিছের আবির্ভাবের পিছনে যে রহস্য আছে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়, এখন ঘড়ির নেই। আপাতত প্রয়োজন আত্মরক্ষা।
ঘড়ি বিছেটার সামনে জুতোসুষ্ঠু পা এগিয়ে দিয়ে নিচু হয়ে হুলের গুঁড়টা দু’ আঙুলে চেপে ধরে বিছেটাকে তুলে নিল। এই অবস্থায় বিছে খুবই অসহায়।
হুলটা সাবধানে ধরে রেখে বিছেটাকে কাছ থেকে যখন দেখল ঘড়ি, তখন সে স্পষ্টই বুঝতে পারল, এটা আসল কাঁকড়াবিছে মোটেই নয়। বিছেটার শরীর ধাতু দিয়ে তৈরি। ভিতরে স্প্রিং আছে, তার জোরে বিছের পা নড়ে। মুখের কাছে একটা লম্বা দাঁড়া রয়েছে যা অনেকটা সূক্ষ্ম টেলিস্কোপিক অ্যান্টোনার মতো।
হুলটা ভাল করে লক্ষ্য করল ঘড়ি। যা দেখল, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। হুলের বদলে যেটা বারবার বেরিয়ে আসছে, তা স্টেনলেস স্টিলের তৈরি একটা ফাঁপা উঁচ। অনেকটা ইনজেকশন দেওয়ার ছুঁচের মতোই।
ঘড়ি তার রুমালটা বের করে ছুঁচের মুখে ধরতেই সেটা বিঁধে গেল রুমালে আর কয়েক ফোঁটা ভারি সুগন্ধি তরল বস্তু বেরিয়ে এল ছুঁচ থেকে।
২৬-৩০. অন্ধকারে যখন আংটি চোখ মেলল
অন্ধকারে যখন আংটি চোখ মেলল, তখন তার মাথাটা ঘুমে ভরা। কোথায় শুয়ে আছে সেই বোধটা পর্যন্ত নেই। কিছুক্ষণ ডোম্বলের মতো চেয়ে থাকার পর হঠাৎ সে তড়াক করে উঠে বসল। বিছানার পাশে একটা ভূত দাঁড়িয়ে আছে।
ভূত যে তাতে কোনও সন্দেহই নেই। মুখটা ভাল দেখা না গেলেও এরকম শীর্ণকায় এবং লম্বা চেহারা পোক বড় একটা নেই। এই সেই নকল রাজার সেক্রেটরি, যাকে সে এবং তার দাদা ঘড়ি বাসের মধ্যে খুন হতে দেখেছিল।
মারপিট আংটি বিস্তর করেছে, কিন্তু ভূতের সঙ্গে কীভাবে লড়তে হয় তা তার অজানা। তার ওপর তার ভূতের ভয়ও আছে।
সুতরাং আংটি একটা বিকট খ্যাখ্যা শব্দে গলাখাঁকারি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কে, কে আপনি?”
লম্বা সিঁড়িঙ্গে ছায়ামূর্তিটা আংটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। পাথরের মতো স্থির। আংটি প্রশ্নের জবাবে একটু ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “তুমি এখানে কী করছ?”
আংটি তোতলাতে লাগল, আ…আমি…..আমি….কিন্তু আ-আপনি তো মরে গিয়েছিলেন!”
লম্বা লোকটা নিজের কোমরে হাত দিয়ে কোনও একটা বোতাম টিপল। আংটি দেখল লোকটার পায়ের দিকে, বোধহয় জুতোয় লাগানো একটা আলো জ্বলে উঠল এবং লোকটাকে বেশ স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল। তবে তলার দিক থেকে আলো ফেললে যে-কোনও মানুষকে একটু ভৌতিক-ভৌতিক দেখায়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা গায়ে আলো ফিট করা লোক জীবনে দ্যাখেনি আংটি।
সে ফের আমতা-আমতা করে বলল, “আ-আপনি কিন্তু আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন।”
লোকটা মৃদু ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “এখন দ্যাখো তো, আমি মরে গেছি বলে কি মনে হচ্ছে?”
আংটি দেখল, বাস্তবিকই লোকটার শরীরে কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই। একটু ভূতুড়ে দেখালেও লোকটাকে তার জ্যান্ত বলেই মনে হচ্ছিল। মাথাটা গুলিয়ে গেল আংটির। সে বোকার মতো জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি জ্যান্ত মানুষ?”
লোকটা আলো নিবিয়ে দিয়ে বলল, “জ্যান্ত কি না জানি না, তবে ভূত-টুত নই।”
“তা-তার মা-মানে?”
“মানে বললেও তুমি বুঝতে পারবে না। সে কথা থাক। এখন বলো তো, তোমরা দুই ভাই আমাদের কাছে পালিয়ে এলে কেন?”
“আমরা ভেবেছিলাম, আপনারা আমাদের কিডন্যাপ করছেন।”
“কিডন্যাপ কি ওভাবে করে? তোমাদের খেলা দেখে মহারাজ খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি তোমাদের উপকার করতে চেয়েছিলেন। পালিয়ে এসে তোমরা ওঁকে অপমান করেছ।”
দাদা ঘড়ি থাকলে আংটি তেমন ভয় পায় না। কিন্তু একা বলেই তার বেশ ভয়-ভয় করছিল। সে কঁপা কাঁপা গলায় বলল, “উনি যে আমাদের উপকার করতে চেয়েছিলেন তা আমরা বুঝতে পারিনি।”
‘তা না হয় পারেনি, কিন্তু তোমরা ওঁকে মারারও চেষ্টা করেছ। আজ অবধি ওঁর গায়ে হাত তুলে কেউ রেহাই পায়নি।”
আংটি তাড়াতাড়ি বলল, “আমি সেজন্য মাপ চাইছি।”
“মাপ স্বয়ং মহারাজের কাছেই চাওয়া উচিত। উনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমার সঙ্গে এসো।”
আংটি অবাক হয়ে বলল, “উনি কি এখানে আছেন?”
“আছেন বই কী।”
আংটি চারদিকে একবার চেয়ে নিল। দাদা ঘড়ি সঙ্গে নেই, সে একা। এই অবস্থায় আবার এদের খপ্পরে পড়লে রেহাই পাওয়া অসম্ভব হবে। সুতরাং পালাতে হলে এই বেলাই পালানো দরকার। সিঁড়িঙ্গে লোকটা বোধহয় দৌড়ে তার সঙ্গে পেরে উঠবে না। পারলে জঙ্গলের মধ্যেই তাদের তাড়া করত।