নিজের ঘরে এসে জানালা খুলে যখন ঘড়ি ছাদের পরিস্থিতিটা উৎকর্ণ হয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল, তখনই সে আকাশের অদ্ভুত বস্তুটা দেখতে পায়। অনেকটা পটলের আকৃতি, নীলাভ উজ্জ্বল একটা জিনিস ধীরে-ধীরে নেমে আসছে।
তখন ঘড়ি তার ঘুমকাতুরে ভাই আংটিকে ডেকে বলল, “এই ওঠ, দ্যাখ কী কাণ্ড হচ্ছে।”
আংটি উঠে জিনিসটা দেখল এবং রুদ্ধশ্বাসে বলল, “উফো, আনআয়ডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট।”
অপলক চোখে দুই ভাই জিনিসটা লক্ষ্য করতে লাগল। কিন্তু হঠাৎই আলো নিবে গিয়ে বস্তুটা অন্ধকার হয়ে গেল। আর দেখা গেল না।
ডাকাবুকো বলে দুই ভাইয়েরই খ্যাতি আছে। তারা সহজে ভয় খায় না। দুনিয়ায় তাদের যত ভয় বাবাকে। অথচ হরিবাবুর মতো নিরীহ আনমনা ভালমানুষ লোক হয় না। ছেলেদের গায়ে তিনি কখনও হাত তোলেননি। বকাঝকাও করেন না বড় একটা। তবু দুই ডানপিটে ভাই ওই একজনকে যমের মতো ডরায়। আর কাউকে বা কিছুতেই তারা ভয় পায় না। উড়ন্ত-চাকিকেই বা পাবে কেন?
দুই ভাই চটপট শীতের পোশাক পরে নিল। মাথায় বাঁদুরে টুপি আর হাতে দস্তানা পরতেও ভুলল না। অস্ত্র বলতে ঘড়ির একটা স্কাউট ছুরি আর আংটির চমৎকার একটা গুলতি। আর সম্বল গায়ের জোর এবং মগজের বুদ্ধি।
এ শহরের সবরকম শর্টকাট তাদের জানা। কাজেই গজ-পালোয়ানের আস্তানায় পৌঁছুতে দেরি হল না।
চক-সাহেবের বাড়ির পর বিশাল জলা। তার ওপাশে পুঁতেবন। আর আছে বিখ্যাত সেই রাজবাড়ির ঢিবি। জায়গাটা বেশ গোলমেলে। অজস্র ঝোঁপঝাড় আর জলকাদায় দুর্গম। তবে ঘড়ি আর আংটি এ জায়গা নিজেদের হাতের তেলোর মতোই চেনে।
ঘড়ি চারদিকে চেয়ে বলল, “আমার যতদূর মনে হয় উফোঁটা জলার ওপাশে ছুঁতেবনের দিকে কোথাও নেমেছে।”
আংটি গম্ভীর মুখে বলল, “হু, কিন্তু জলা পার হবি কী করে?”
আসলে আংটি একটু শীতকাতুরে।
ঘড়ি গম্ভীর মুখে বলল, “জলা পার হতে হলে জলে নামতে হবে।”
“ও বাবা, আমি বরং এদিকটায় পাহারা দিই, তুই এগিয়ে দেখে আয়।”
ঘড়ি কিন্তু এই প্রস্তাবে আপত্তি করল না। পকেট থেকে ছোট্ট একটা টর্চ বের করে চারদিকটা দেখে নিয়ে বলল, “চক সাহেবের বাড়িতে একটু আগে একটা আলো দেখেছি। যতদূর জানি, গজ-পালোয়ান এখন ও-বাড়িতে নেই। কিন্তু আলো যখন দেখা গেছে, তখন কেউ না কেউ আছে ঠিকই। তুই চারদিকে নজর রাখিস। বিশেষ করে চক-সাহেবের বাড়ির দিকটায়। আমি জলার ওদিকটা দেখে আসছি।”
আংটি ঘাড় নাড়ল প্রকাণ্ড একটা হাই তুলতে তুলতে। তারপর বলল, “আমি বরং চক-সাহেবের বাড়িতেই গিয়ে ঢুকে পড়ি। গজদার বিছানাটা পড়ে আছে, একটু গড়িয়ে নিইগে। তুই ফিরে এসে আমাকে ডেকে নিস।”
.
ঘড়ি তার প্যান্টের পা গুটিয়ে জুতোসুদু জলে নেমে পড়ল।
অন্ধকার জলের মধ্যে ঘড়ি মিলিয়ে যাওয়ার পর আংটি আর-একটা বিকট হাই তুলল। ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে। কৌতূহল তার যতই হোক শীত আর রাতজাগা সে একদম সইতে পারে না।
চক-সাহেবের বাড়ি বেশি দূর নয়। আংটি চারদিকটা লক্ষ্য করতে করতে গিয়ে বাড়িটায় ঢুকে পড়ল। ঘড়ি বলল আলো জ্বলতে দেখেছে, কিন্তু আংটি কোথাও কোনও আলোর চিহ্ন পেল না। তবু সাবধানের মার নেই। সে চার দিকটা ঘুরে ঘুরে দেখে নিল। না, কোথাও কেউ নেই। গজ-পালোয়ানের ঘরে ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে দেখল, চৌকির ওপর বিছানা পাতাই রয়েছে। সামান্য কিছু জিনিসপত্র যেমন-কে তেমন পড়ে আছে।
আংটি আর একটা হাই তুলে বিছানার চাঁদরটা তুলে ভাল করে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। গায়ে গরমজামা থাকায় তেমন শীত করল না। ঘুমও এসে গেল টপ করে।
গাঢ় ঘুমের সময় মানুষের শাস যেমন ঘন-ঘন পড়ে, সেরকমই শ্বাস পড়তে লাগল আংটির। মৃদু-মৃদু নাকও ডাকছিল তার।
মিনিট পনেরো কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ খুব ধীরে ধীরে ঘরের দরজাটা খুলে গেল। নিঃশব্দে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল দরজায়।
জলা পার হতে ঘডির বিশেষ সময় লাগল না। জল থেকে ডাঙায় উঠে সে টর্চ জ্বেলে পায়ে জোঁক লেগেছে কি না দেখে নিল। তারপর রাজবাড়ির ঢিবির নীচে উঁচু জমিতে উঠে জুতো খুলে মোজাটা নিংড়ে নিয়ে ফের পরল।
তুঁতেবন এখনও বেশ খানিকটা দূরে। ঘড়ি উঠল। উঠতে গিয়েই হঠাৎ তার। নজরে পড়ল ঢিবিটার গায়ে ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে বেশ বড় একটা গর্ত। এরকম গর্ত থাকার কথা নয়। আর আশ্চর্যের কথা, গর্তের ভিতর থেকে একটা আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ঘড়ি ভারি অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ তার মনে হল, মহাকাশযানটা ওই ঢিবির মধ্যে গিয়ে সেঁধোয়নি তো!
ঘড়ি ধীরে ধীরে ঢিবির ঢাল বেয়ে গর্তটার মুখ-বরাবর চলে এল। ভয় যে করছিল না তা নয়। কিন্তু কৌতূহলটাই অনেক বেশি জোরালো।
ঢিবির মুখে এসে সাবধানে উঁকি দিয়ে ভিতরে যা দেখল, তাতে বেশ অবাক হয়ে গেল সে। দিব্যি আলোকিত সুড়ঙ্গ। ভিতরটা বেশ পরিষ্কার।
যেন চুম্বকের টানে সম্মোহিতের মতো ঘড়ি ভিতরে ঢুকল। চারদিকে চেয়ে সে বুঝল, ঢিবিটা সম্পর্কে যে কিংবদন্তি প্রচলিত আছে, তা মোটেই মিথ্যে নয়। বাস্তবিকই এখানে কোনওদিন একটা প্রাসাদ ছিল।
কিন্তু তার চেয়েও যেটা বিস্ময়কর, তা হল, সুড়ঙ্গটাকে কে বা কারা খুব যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করেছে। ভিতরে খুঁড়ে খুঁড়ে ছোট বড় নানা রকম কুঠুরি বানিয়েছে। সব কুঠুরিরই দরজা বন্ধ। সুড়ঙ্গের ছাদে লাগানো আলোগুলো দেখে ঘড়ি হাঁ হয়ে গেল। ইলেকট্রিক লাইট নয়, স্রেফ এক-একটা উজ্জ্বল পাথর।