তার বাবা শিবু হালদারও কবিতা লিখতেন শুনে হরিবাবুর খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু হলেন না, ব্যাজার মুখে বললেন, “থাক, আর শুনতে চাই না।”
“সে না হয় না-চাইলেন, কিন্তু খিদের ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত এইবেলা করে নিন। লুচি খেয়েছেন কি খাননি, খিদে পেয়েছে কি পায়নি এসব বেশ ভাল করে ভেবেচিন্তে ঠিক করে নিন। লুচি যদি না খেয়ে থাকেন, তবে আর অবেলায় সেটা খেয়ে কাজ নেই। বরং ব্রাহ্মণভোজন লাগিয়ে দিন। জিনিসটারও সঙ্গতি হল, খানিক পুণ্যিও পেয়ে গেলেন।”
“তুমি বড্ড বেশি বাচাল তো হে।”
“আজ্ঞে পেটটা ফাঁকা থাকলে আমার বড় কথা আসে। সে যাকগে, যা বলছিলাম। একদিন মাঝরাত্তিরে ল্যাবরেটরি-ঘরে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড শুনে ঘুম ভেঙে গেল। তড়াক করে উঠে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি তিনটে এই জোয়ান কালা সাহেব শিবুবাবুকে রাম-ধোলাই দিচ্ছে। দেখে আমি ভিরমি খাই আর কী, কিন্তু ভিরমি খেতে খেতেও দেখলাম শিবুবাবু তিনটে সাহেবকেই একে একে নিকেশ করে ফেললেন।”
হরিবাবু কেঁপে উঠে বললেন, “বলো কী?”
“তাও আলপিন দিয়ে।”
“অ্যাঁ! আলপিন?”
“তবে আর বলছি কী? ঠিক আলপিন নয় বটে, তবে ও-রকমই সরু আর ছোট্ট পিস্তল ছিল তাঁর, মুখ থেকে সুতোর নালের মতো সূক্ষ্ম গুলি বেরোত। সাহেবরা তো অত কলকজা জানে না। শিবুবাবু তাদের খুন করে আমাকে ডাকলেন। দু’জনে ধরাধরি করে তিন-তিনটে লাশকে ওই বাগানের পশ্চিমধারে পুঁতলাম। দেখছেন না ওখানে কেয়াগাছটার কেমন বাড়বাড়ন্ত। জৈব সার পেয়েছে কিনা।
০৩.
হরিবাবু লোকটাকে বিশ্বাস করছেন না ঠিকই, কিন্তু কথাগুলো একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। কেয়াঝোঁপটার দিকে তাকিয়ে একটু দুর্বল গলায় বললেন, “গুলমারার আর জায়গা পাওনি? আমার বাবাকে খুনি বলে বদনাম দিতে চাও?”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে আত্মরক্ষার জন্য খুন করলে সেটাকে খুন বলে ধরা হয় না। আইনেই আছে। শিবুবাবু তো নিজেকে বাঁচাতে খুন তিনটে করেছিলেন। এখনও ওই কেয়াঝোঁপের এলাকার মাটি খুঁড়লে তিনটে কঙ্কাল পাওয়া যাবে। শাবল-টাবল নেই বাড়িতে? দিন না, খুঁড়ে দেখাচ্ছি।”
হরিবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “থাক্ থাক্, তার দরকার নেই। পঞ্চানন্দ তার খড়িওঠা গা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “একটু চান-টান করা দরকার, বুঝলেন! খাঁটি সর্ষের তেল ছাড়া আমার সহ্য হয় না। এক টুকরো গন্ধসাবান কি পাওয়া যাবে?”
রাগে হরিবাবু ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন। চোখ দিয়ে লোকটাকে প্রায় ভস্ম করে দিতে দিতে বললেন, “আর কী কী চাই তোমার বাপু?”
পঞ্চানন্দ মাথা চুলকে বলল, “আরও কিছু চাই বটে, কিন্তু ঠিক মনে পড়ছে না। তা ক্রমে ক্রমে বলব’খন। এখন একটু তেল আর সাবান হলেই হয়। আমার গরম জল লাগে না, গামছারও দরকার নেই আর ফুলেল তেল না হলেও চলবে।”
“বটে।”
লোকটা গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, “দাড়িটা বড্ড কুটকুট করছে তখন থেকে। আট গণ্ডা পয়সা পেলে সেলুনে গিয়ে কামিয়ে আসতাম। আর মাথার অবস্থাটাও.দেখুন, চুল একেবারে কাকের বাসা। তা ধরুন আরও পাঁচসিকে হলে চুলটার একটা গতি হয়।”
“ব্ল্যাকমেল করার ফিকিরে আছ তো? দেখাচ্ছি ব্ল্যাকমেল!”
“মেল? আজ্ঞে মেট্রেনের কথা উঠছে কেন বলুন তো? আমার তো এখন কোথাও যাওয়ার নেই? তবে ফিকিরের কথা যদি বলেন তো বলতে হয়, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি খুব ফিকিরের লোক। শিবুবাবু যখন আকাশী জামা বানালেন, তখন সেই জামা পরে আমিও তাঁর সঙ্গে আকাশে উঠে যেতুম। হেঃ হেঃ! খুব মজা হত মশাই। দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে আকাশে ঘুরে বেড়ানো। মেঘের রাজ্যে ঢুকে সে যে কী রগড়ই হত! তা তখন একদিন একটা ফিকির খেলল মাথায়। একদিন দুধ চিনি সব সঙ্গে নিয়ে গিয়ে খানিকটা মেঘ মিশিয়ে দিব্যি আইসক্রিম বানিয়ে খেলুম দুজনায়। শিবুবাবুও বলতেন, পঞ্চানন্দ, তুই খুব ফিকিরের লোক।”
“আকাশী জামা?” হরিবাবুর চোখ একদম রসগোল্লার মতো গোল হয়ে গেল।
“তবে আর বলছি কী? শিবুবাবু পাগলা গোছের ছিলেন বটে, তবে বুদ্ধির একেবারে চেঁকি। ফটাফট আজগুবি সব জিনিস বানিয়ে ফেলতেন।”
“কই, আমি তো এইসব আবিষ্কারের কথা শুনিনি?”
“খুব গোপন রেখেছিলেন কিনা। সর্বদাই শত্রুপক্ষের চরেরা ঘুরঘুর করত যে। ওই তিনটে সাহেব খুন হল কি এমনি-এমনি? তারাও মতলব নিয়েই এসেছিল। আরও সব আসত। মিশমিশে কালো লোক, চ্যাপটা নাক আর ঘোট চোখ-অলা লোক, বাদামি রঙের ঢ্যাঙা চেহারার লোক, বেঁটে বক্কেশ্বর চেহারার লোক। তারা বড় ভাল লোকও ছিল না। একদল তো চিঠি দিয়েছিল, যদি আকাশী জামার গুপ্ত কথা আমাদের না জানান, তো আপনার ছেলে হরিকে চুরি করব।”
“বলো কী?”
“আজ্ঞে একেবারে নিয্যস সত্যি। চুরি করে নিয়ে মেরেই ফেলত বোধহয়। সেই ভয়ে শিবুবাবু শেষ দিকটায় সব লুকিয়ে-টুকিয়ে ফেললেন, জিনিসও আর তেমন বানাতেন না। তবু ওলন্দাজের হাতে প্রাণটা দিতে হল।”
“তার মানে? ওলন্দাজটা আবার কি?”
“আচ্ছা মশাই? আপনার কি খিদে-তেষ্টা নেই নাকি? আপনার না থাক, আমার আছে। যদি অসুবিধে থাকে তো বলুন, আমি না হয় অন্য জায়গায় যাই। তখন থেকে বকে-বকে মুখে ফেকো উঠে গেল।”
হরিবাবু একটু নরম গলায় বললেন, “আচ্ছা বাপু বোসো, তেল পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওই দিকে কলাঝাড়ের ওপাশে একটা কুয়ো আছে, চানটান করে নাও গে।”