হরিবাবু খুব কটমট করে পঞ্চানন্দের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটার ওপর সত্যি-সত্যি রাগ করা উচিত কি না তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তবে তার তেমন রাগ হচ্ছে না। রাগ কখনও তার তেমন হয় না। আর রাগ হয় না। বলেই সংসারে তার মতামতের দাম এত কম। সে যাকগে, হরিবাবু যথাসাধ্য রাগ-রাগ গলায় বললেন, “তুমি তাহলে একজন খুনি, গুণ্ডা এবং চোর! ঠিক তো?”
“আজ্ঞে খুব ঠিক। লোক আমি মোটেই সুবিধের নই।”
“কিন্তু তাহলে আমার বাবার সঙ্গে তোমার এত মাখামাখি হল কী করে?”
পঞ্চানন্দ জামাটা তুলে মুখটা তাই দিয়ে মুছে নিয়ে বলল, “লোক ভাল হলে কী হবে, শিবু হালদার মশাই ছিলেন মাথা-পাগলা লোক। ওই সায়েন্স সায়েন্স করেই মাথাটা বিগডোল। আমার চালচুলো ছিল না, এখনও অবিশ্যি নেই, তা আমি সারাদিন কুড়িয়ে-বাড়িয়ে-চেয়েচিন্তে চুরি-ডাকাতি করে খেতাম। রাত্তিরের দিকটায় ওই আপনাদের পুবদিককার দালানের বাইরের বারান্দায় চট পেতে শুয়ে থাকতাম।……তা বাবু, খুব পোলাও রাঁধার গন্ধ পাচ্ছি যে, বাড়িতে কি ভোজ?”
“রোববারে ভালমন্দ হয় একটু।”
“হয়? বাঃ, বেশ। তা আপনারা ব্রাহ্মণভোজন করান না?”
“তুমি কি বাপু ব্রাহ্মণ?”
পঞ্চানন্দ একগাল হেসে বলল, “ছিলাম বোধহয়। অনেককালের কথা তো। কিন্তু মনে হয় ছিলাম যেন ব্রাহ্মণই। নিদেন দরিদ্রনারায়ণসেবাও তো করতে পারেন।”
স্পর্ধা দেখে হরিবাবু অবাক হন। লোকটা নির্লজ্জও বটে। তবে একেবারে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিতেও তার বাধছে। লোকটা একটা পেতলের চাবি আর একটা সংকেত দিয়েছে। কোনো গুপ্তধনের হদিস কি না তা হরিবাবু জানেন না। গুলগপ্পোও হতে পারে। হরিবাবু খুব কটমট করে লোকটার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “ঠিক আছে, ব্রাহ্মণভোজন বা দরিদ্রনারাণসেবা যা হয় একটা হবে’খন। তবে সে সকলের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে।”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলে, “সে আর বলতে। সব বাড়িতেই এক ব্যবস্থা। আমারও হলেই হল।”
‘হ্যাঁ, কি বলছিলে যেন?”
পঞ্চানন্দ মুখটা করুণ করে বলল, “আজ্ঞে সেই হিমালয় থেকে টানা হেঁটে আসছি। মানুষের শরীর তো। একটু বসে-টসে একটু হাঁফ ছাড়তে ছাড়তে কথাটথা বললে হয় না? শিবুবাবুর ঘরখানা যদি ফাঁকা থাকে তো তার দাওয়াতেই গিয়ে একটু বসি চলুন।”
হরিবাবু দোনোমনো করে বললেন, “ঘর ফঁকাই আছে। বাবার ল্যাবরেটরিতে আমরা কেউ ঢুকি না। আমার ছেলে মাঝে-মাঝে খুটখাট করে গিয়ে। তা এসো।”
শিবু হালদারের ল্যাবরেটরি খুব একটা দেখনসই কিছুই নয়। বাড়ি থেকে কিছুটা তফাতে, খুব ঘন গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ে প্রায় ঢাকা, লম্বা একটা একতলা দালান। এদিকটা খুব নির্জন। ইদানীং সাপখোপের বাসা হয়েছে। ল্যাবরেটরিতে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, শিশিবোতল, জার, রাসায়নিক এখনও আছে। কেউ হাত দেয়নি। বারান্দাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সেই দাওয়ায় বসে পঞ্চানন্দ জামার ঝুল দিয়ে ফের মুখ মুছল। তারপর বলল, “পোলাওয়ের গন্ধটা খুব ছড়িয়েছে কিন্তু মশাই। তা বেগুনি-টেগুনিও হবে নাকি? চাটনি? মাংস তো বলতে নেই, হচ্ছেই। মাছও কি থাকছে সঙ্গে? দই খান না আপনারা? আগে এদিককার রসোমালাই খুব বিখ্যাত ছিল, আর ছানার গজা।”
হরিবাবু আবার রেগে যাওয়ার চেষ্টা করে বললেন, “এটা কি বিয়েবাড়ি নাকি? ওসব খাওয়ার গপ্পো এখন বন্ধ করো। কাজের কথা বলো দেখি।”
পঞ্চানন্দ বেশ জেঁকে বসল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে একটা আরামের শ্বাস ফেলে বলল, “এইখানটাতেই শুয়ে থাকতাম এসে। শিবুবাবু অনেক রাত অবধি ঘরের মধ্যে কী সব মারণ-উচাটন করতেন।”
হরিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “মোটেই মারণ-উচাটন নয়। নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতেন।”
“ওই হল। তা একদিন রাত্রিবেলা সবে চোখদুটো লেগেছে, তখন এসে আমাকে ঠেলে তুললেন, ‘ওরে ওঠ ওঠ, দেখে যা কাণ্ডখানা।’ তা চোখ কচলাতে কচলাতে গিয়ে ঢুকলাম শিবুবাবুর জাদুঘরে। বললে বিশ্বাস করবেন না যা দেখলাম তাতে চোখ ছানাবড়া!”
“কী দেখলে?”
“একখানা কাঁচের বাক্সে ব্যাঙের ছাতার মতো আকৃতির ঘন ধোঁয়া আর সাদা আগুনের ঝলকানি। শিবুবাবু কী বললেন জানেন? বললেন, “জাপানিরা নাকি বড়-বড় গাছের বেঁটে-বেঁটে চেহারা করতে পারে। তাকে বলে বানসাই।”
“জানি। এক বিঘত বটগাছ, ছ’আঙুল তেঁতুলগাছ তো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। তা শিবুবাবু সেইরকমই একখানা বানসাই অ্যাটম বোমা বানিয়েছেন। কাঁচের বাক্সের মধ্যে বিঘতখানেক উঁচু সেই কাণ্ডখানা হল সেই বানসাই অ্যাটম বোমার কাজ।“
“বলো কী?”
“সে তো গেল একটা ঘটনা। বৃত্তান্ত আরও আছে।”
“আছে? বলে ফেলো?”
“শুনবেন? আপনার খিদে পাচ্ছে না?”
“খিদে? না, এই তো লুচি খেলাম। ও হো, না না, আমি তো লুচি খাইনি। হা, খিদে তো পেয়েছে হে।”
পঞ্চানন্দ একগাল হেসে বলল, “ঠিক করতে পারছেন না তো? শিবুবাবুও তাই বলতেন, আমার বড় ছেলেটা একেবারে অকালকুষ্মান্ড না হয়ে যায় না। তা না হয় হল, কিন্তু আবার কবিও না হয়ে বসে।”
একটু সংকুচিত হয়ে গিয়ে হরিবাবু বললেন, “কবিদের ওপর তার খুব রাগ ছিল নাকি?”
“রাগ ছিল না আবার! কবি শুনলেই খেপে উঠতেন। অবশ্য খেপবারই কথা। বয়সকালে ঝুড়ি ঝুড়ি কবিতা লিখে লিখে কাগজে পাঠাতেন, কেউ ছাপত না। হন্যে হয়ে উঠেছিলেন ছাপানোর জন্য। এমনকি, তিন-চারজন সম্পাদককে ধার পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তবু ছাপা হয়নি। কবিদের ডেকে এনে খুব খাওয়াতেন, কবিদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, এক কবি তার চেনসুন্ধু সোনার ঘড়ি ধার নিয়ে আর ফেরত দিল না। আর এক কবি…”