হরিবাবু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “তাহলে মাথা কিনে নিয়েছ আর কী। দূর থেকে আসছ তো কী? আসতে বলেছিল কে? না এলেই বা এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হত?”
লোকটা এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর খুঁজে না পেয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “তা বটে, না এলেও হত।”
“তাহলে এবার কেটে পড়ো। যত দূর থেকে এসেছ, আবার তো দূরেই ফিরে যাও। নইলে পুলিশ ডাকব।”
লোকটা মাথা নাড়ল। অর্থাৎ সে বুঝেছে। কিছুক্ষণ ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থেকে লোকটা খুব ভয়েভয়ে বলল, “আজ্ঞে একটা কথা ছিল। সেটা জেনেই চলে যাব।”
“কী কথা? আঁ, তোমার মতো ভ্যাগাবরে আবার কথা কিসের? যত সব গাঁজাখুরি দুঃখের কথা বানিয়ে বানিয়ে বলবে, আর বাড়ির দিকে আড়ে-আড়ে চেয়ে কোথায় কি আছে নজর করবে তো? ওসব কায়দা আমি ঢের জানি।”
লোকটা সঙ্গেসঙ্গে বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে কথাটা ঠিকই বলেছেন। দিনকাল ভাল নয়। চারদিকে চোর-জোচ্চোর সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। উটকো লোককে প্রশ্রয় না দেওয়াই ভাল। তবে আমার কথাটা খুবই ছোট। আমি শুধু জিজ্ঞেস করছিলাম এটাই শিবু হালদার মশাইয়ের বাড়ি কি না।”
‘হলে কী করবে?”
“তার বড় ছেলেকে একটা কথা বলে যাব আর একটা জিনিস দিয়ে যাব।”
“কী কথা? কি জিনিস?”
“আজ্ঞে সে তো শিবু হালদার মশাইয়ের বড় ছেলে ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না।”
হরিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আমিই শিবু হালদাবেরর বড় ছেলে, আর এটাই শিবু হালদারের বাড়ি।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আমিও এরকমই অনুমান করেছিলাম।”
হরিবাবু বললেন, “আর তোমার অনুমানের কাজ নেই। শিবু হালদারের বাড়ি এশহরের সবাই চেনে। বেশি বোকা সেজো না। যা বলবার বলে ফেলো।”
লোকটা ভারি কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “আজ্ঞে আমি একরকম তাঁর কাছ থেকেই আসছি।”
“একরকম! একরকম মানেটা কী হল হে? তার কাছ থেকে আসছ মানেটাই বা কী? ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পেলে না?”
লোকটা সবেগে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “আপনি বড় ভড়কে দেন মানুষকে। অত ধমকালে কি বুদ্ধি ঠিক থাকে?”
“বুদ্ধি অনেক খেলিয়েছ, এবার পেটের কথাটি মুখে আনো তো বাছাধন।
শিবু হালদারকে তুমি পেলে কোথায়? তিনি তো বছর বিশেক আগেই গত হয়েছেন।”
“আজ্ঞে তা হবে। তিনি যে আর ইহধামে নেই সে-কথা খবরের কাগজেই পড়েছিলাম। স্বনামধন্য লোক ছিলেন। বাঙালির মধ্যে অমন প্রতিভা খুব কম দেখা যায়।”
“তা কথাটা কী তা বলবে?”
“বলছি। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা প্রায় ত্রিশ বছর আগে। আপনি তখন এইটুকু।”
“বটে! তা তুমি তখন কতটুকু?”
“আমাকে দেখে বয়সের অনুমান পাবেন না।”
“তাই নাকি ব্যাটা হনুমান? ডাকব ন্যাড়াকে?”
“থাক থাক, লোক ডাকতে হবে না। আপনি একাই একশো। শিবু হালদার মশাই বলতেন বটে, ওরে পীতাম্বর, তুই দেখে নিস,আমার বড় ছেলে এই হরি একদিন কবি হবে। ওর হাত পা চোখ সব কবির মতো, তা দেখছি, শিবু হালদারের মতো বিচক্ষণ লোকেরও ভুল হয়। কবি কোথায়, এ তো দেখছি দারোগা।”
এ-কথায় হরিবাবুর এবার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার পালা। খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললেন, “বাবা বলতেন ও-কথা?”
“তবে কি বানিয়ে বলছি?”
হরিবাবু ঢোঁক গিলে বললেন, “তুমি বাপু বড্ড ঘড়েল দেখছি। শিবু হালদারকে চিনতে, তার মানে তোমার বয়স তখন……”
লোকটা শশব্যস্তে বলল, “বেশি নয়, চল্লিশের মধ্যেই। এখন এই সত্তর চলছে।”
‘‘সত্তর?”
“সামনে মাসে একাত্তর পূর্ণ হবে।”
“মিথ্যে কথা!” লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কেউ বিশ্বাস করে না। তা সে যাকগে। গত ত্রিশ বছর তার একটা দায় কাঁধে নিয়ে ঘুরছি। সেই দায় থেকে মুক্ত হতে আসা।”
বলে লোকটা পাজামার কোমর থেকে একটা গেঁজে বার করে আনল। তারপর সেটা হরিবাবুর হাতে দিয়ে বলল, “ঈশান কোণ, তিন ক্রোশ”।
হরিবাবু অবাক হয়ে বললেন, “তার মানে?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আর জানি না। শিবু হালদার মশাই এর বেশি আর বলেননি।”
০২.
উটকো লোকটার ওপর হরিবাবুর আর তেমন যেন রাগ হচ্ছিল না। তবু রাগের ভাবটা বজায় রেখে একটু চড়া গলায় বললেন, “আমাকে ধাঁধা দেখাচ্ছ? ভাবছ তোমার সব কথা বিশ্বাস করছি? ঈশান কোণ আর তিন ক্রোশ, এর কোনো মানে হয়?”
লোকটা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “আরে চুপ চুপ। এসব অতিশয় গোপন কথা। শিবুবাবু পইপই করে বারণ করেছিলেন, পাঁচকান যেন না হয়। আমার কর্তব্যটুকু করে গেলাম, ঘাড় থেকে দায় নেমে গেল, এবার তাহলে যাই।”
“গেলেই হল? তোমার নাম বলল, ঠিকানা বলো, কী কাজটাজ করো একে একে তাও বলো।”
লোকটা মাথা চুলকে খুব বিনীতভাবে বলল, “নাম তো মেলা। এক-এক জায়গায় এক-এক রকম। কোটা বলব?”
হরিবাবু ভড়কে গিয়ে বলেন, “অনেক রকম নাম কেন?”
“আজ্ঞে সে অনেক কথা, বললে আপনি রাগ করবেন।”
“আহা, যেন এখন আমি রেগে নেই! আমাকে আর রাগালে কিন্তু একদম রেগে যাব, তখন বুঝবে! আমার এক ভাই কুস্তিগির, এক ভাই পুলিশ, আমি—“
“আজ্ঞে আর বলতে হবে না। শিবুবাবু খুব গেরোতে ফেলেছেন বুঝতে পারছি। কথাটা কী জানেন, আমি তেমন ভাল লোক নই। যেখানেই যখনই থাকি, একটা না একটা অপকর্ম করে ফেলি। ঠিক আমিই যে করি তা বলা যায় না। তবে আমার হাত দুখানা করে ফেলে। তা সে একরকম আমারই করা হল।”
“বটে! বটে! তা অপকর্মগুলো কীরকম?”
কোথাও খুন, কোথাও ডাকাতি, কোথাও চুরি, এই নানারকম আর কী, পুলিশ পিছনে লাগে বলে নামধাম চেহারা সবই পাল্টাতে হয়। তা এই করতে করতে নিজের নামটা একেবারে বিস্মরণ হয়ে গেল। কখনও মনে হয় চারুদত্ত, কখনও মনে হয় মেঘদূত, কখনও মনে হয় দ্বৈপায়ন। কিছুতেই স্থির করতে পারি না কোনটা। তাই লোকে জিজ্ঞেস করলে যা হয় একটা বলে দিই। এই যেমন এখন আপনি জিজ্ঞেস করার পর হঠাৎ মনে হল আমার নাম বোধহয় পঞ্চানন্দ। কোত্থেকে যে নামটা মাথায় এল, তাই বুঝতে পারছি না। এরকম নাম জন্মে শুনিনি।”