কাণ্ডটা কী হয়েছিল কেউ ভাল জানে না, তবে হঠাৎ একদিন শোনা গেল যে, হাবুর পোষা বাঘটাকে পাওয়া যাচ্ছে না, চারদিকে খোঁজ খোঁজ। অবশেষে একদিন দেখা গেল থানার হাতায় গদাই দারোগার কোয়ার্টারের বাগানের বেড়ায় বাঘের চামড়াটা রোদে শুকোচ্ছে।
এই ঘটনায় গঞ্জে হৈ-চৈ পড়ে গেল। সবাই ভেবে নিল, হাবুর বাঘ যখন মরেছে, তখন গদাইয়ের আর রক্ষে নেই। তার মুণ্ডু কেটে নিয়ে শিগগিরই হাবু গেণ্ডুয়া খেলবে।
বাঘ গুম হওয়ার সময়ে হাবু গঞ্জে ছিল না। বাইরে কোথাও ডাকাতি বা লুটপাট করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে সব শুনে দু’দিন গুম হয়ে রইল।
তারপর একদিন সোজা গিয়ে গদাইয়ের বাসায় হানা দিয়ে গদাইকে বলল, “তুমি মরলে কে কে কাঁদবে বলো তো?”
গদাই বিনীতভাবে বলে, “কেউ কাঁদবে না। কারণ, আমি মরব।”
“বটে!” বলে হাবু খানিক অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলল, “মরবে না কেন বল তো! তোমার কি কর্ণের মতো কবচ-কুণ্ডল আছে নাকি?”
“আমার নেই। তবে শুনেছি নাকি আপনার আছে। লোকে বলে আপনি নাকি মেলা ম্যাজিক জানেন।”
হাবু একটা শ্বাস ফেলে বলল, “বাপু, তোমার ভালর জন্যই বলছিলাম, যদি আত্মীয়স্বজন থেকে থাকে–তবে বরং ছুটি নিয়ে গিয়ে তাদের দেখে এসো গে। শেষ দেখা।”
“তার দরকার নেই।”
হাবু হেসে বলল, “দারোগা, তোমার বড় বাড় হয়েছে হে। সে যাকগে, বাঘটা মারলে কি করে বল তো?”
গদাই হাই তুলে বলল, “বাঘ আমি অনেক মেরেছি। তবে আপনার বাঘকে আমি মেরেছি একথা কে বলল?”
“মারোনি?”
“তা বলছি না। বলছি, আমিই যে মেরেছি তার প্রমাণ কী?”
“তবে কি বলতে চাও আমার বাঘটা জঙ্গলে পালিয়ে গেছে? আর যাওয়ার সময় তোমাকে ভালবেসে নিজের চামড়াটা খুলে দিয়ে গেছে?”
গদাই উদাসভাবে বলল, “তাও হতে পারে!”
হাবু তখন গম্ভীর হয়ে বলে, “তাহলে খুব ভাল কথা। আমি আমার সেই চামড়া ছাড়ানো বাঘকে আবার জঙ্গল থেকে ধরে আনব। আর এলে তার গায়ে তোমার শরীরের চামড়াটা খুলে নিয়ে পরিয়ে দেব। তৈরি থেকো।”
গঞ্জের সকলেরই বিশ্বাস : হাবু যা বলে তাই করে। সুতরাং শিগগিরই গদাই দারোগার চামড়া পরানো বাঘকে এই অঞ্চলে দেখা যাবে এই আশায় সবাই চোখ-কান খোলা রেখে অপেক্ষা করতে লাগল।
এক রাতে বিকট শব্দ শোনা গেল–ঘ্যা-ডু-ডু-ডু-ম! সেই শব্দে মাটি কেঁপে ওঠে, বাড়িঘরের দরজা-জানালা নড়ে যায়, আর মানুষের প্রাণপাখি ধুকপুক করতে থাকে। এরকম বিকট বাঘের ডাক কেউ কখনো শোনেনি। তবে কি সত্যিই হাবুর চামড়া-ছাড়ানো বাঘটা ফিরে এল নাকি?
ওদিকে গোঁসাইবাগানের পোড়ো বাড়িতে হাবু আর তার স্যাঙাতরাও চমকে উঠে বসেছে। কান পেতে শুনছে সবাই। বাঘটা খুব কাছ থেকে ডাকল যেন!
প্রথম রাতে বাঘটা সেই একবারই ডেকেছিল।
তারপর ডাকল আর এক রাতে। হাবু সেদিন ময়নাগুড়ির তামাকের কারবারী ঘনশ্যাম বাজোরিয়ার গদিতে চিঠি দিয়ে এসেছিল, একশটি গিনি আর নগদ বিশ হাজার টাকা গোঁসাইবাগানের তেঁতুলতলায় রাত বারোটার পর পৌঁছে দিতে হবে। এ ব্যাপারে কেউ কোনো আপত্তি করে না। অনেকে তো খুশি হয়েই হাবু যা চায় তা দিয়ে দেয়। কারো কারো ধারণা, হাবুকে দিলে পুণ্য হয়। ঘনশ্যামজী অবশ্য সেই দলের লোক নন। একশ গিনি আর বিশ হাজার টাকা তো কম নয়! তবু উপায়ান্তর নেই বলে তিনি রাত বারোটা নাগাদ একটা পুরনো গাড়িতে চড়ে, ড্রাইভার আর একটা চাকরসহ তেঁতুলতলায় এসে অন্ধকারে অপেক্ষা করছেন। প্রচণ্ড শীত, মশা, আর ভয়।
রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিটের সময় গহিন অন্ধকার থেকে একটা কালো মূর্তি এগিয়ে এল। ঘনশ্যামজী কাঁপতে কাঁপতে মূর্তির হাতে গিনি আর টাকার বাক্স তুলে দিলেন। ঠিক সেই সময়ে খুব কাছ থেকে সেই বিকট বাঘের ডাক শোনা গেল–ঘ্যা-ডু-ডু-ডু-ড়া-ম্!
ঘনশ্যামজী মূর্ছা গেলেন। চার আর ড্রাইভার পালাল। আর অন্ধকারের মধ্যে হাবু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ভিতু মানুষ নয়, তার ওপর অনেক ক্ষমতাও সে রাখে। তবু একেবারে কানের কাছে এ বুক কাঁপানো ডাক শুনে কয়েক মুহূর্ত বুঝি তার ধন্দ লেগেছিল।
তারপরই টর্চ জ্বেলে সে অবাক হয়ে দেখে, একটা কাঁটাঝোঁপের আড়ালে প্রকাণ্ড একটা বাঘের ডোরা দেখা যাচ্ছে। আর সেই বাঘের পিঠে একটা মানুষ না? কী আশ্চর্য! বাঘের পিঠে বসে আছে স্বয়ং গদাধর দারোগা!
বাঘটা আর একবার ডেকে উঠল সেই সময়ে। অবাক ও বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাবুর হাত থেকে টর্চবাতি পড়ে গেল। সেই অন্ধকারে বাঘের পিঠে চেপে গদাধর যে কোনদিকে চলে গেল তা আর ঠাহর পেল না হাবু।
সেই থেকে হাবুর হাঁকডাক যেন একটু কমল। আর আগের মতো বুক চিতিয়ে চলল না কয়েকদিন। সেই রাতের ঘটনার দুই দিন পর এক সকালে গদাইয়ের আস্তানায় গিয়ে হাজির হয়ে বলল, “কায়দা-টায়দা সবই শিখে গেছ দেখছি!”
গদাই গম্ভীর স্বরে বলল, “আপনিই শিখিয়েছেন।”
হাবু তেমন কিছু বলল না। কেবল ‘আচ্ছা দেখা যাবে’ গোছের কী একটু অস্পষ্ট স্বরে বলে কেটে পড়ল। সে আর গদাই দারোগার চামড়া ছাড়ানোর কথা বলত না।
এদিকে গদাই রোজ রাম কবিরাজের কাছে যায়। কবিরাজ মশাই তাকে নিয়ম করে নানা অনুপান দিয়ে হরেকরকম পাঁচন খাওয়ান। তাতে গদাইয়ের জোর বাড়ে, বুদ্ধি বাড়ে, মাথা ঠাণ্ডা হয়, সাহস আসে। একদিন রাম কবিরাজ বলেই ফেললেন, “বুঝলে বাবা গদাই, হাবু মনে হয় এবার এ-জায়গা ছেড়ে শটকাবার তালে আছে। যদি শটকে পড়ে, তাহলে কিন্তু ওকে আর শিক্ষা দিতে পারবে না। এইবার মোক্ষম ঘা দাও।”