অয়স্কান্ত সন্ধেবেলায় তার কোয়াটারের বারান্দায় একা বসে বসে পূর্ণিমা দেখছে। এমন সময় রাস্তা থেকে ডোরাকাটা একটা প্রকাণ্ড বাঘ হেলতে-দুলতে ফটক পেরিয়ে সোজা উঠে এল। বাঘের পিঠে হাবু।
অয়স্কান্ত যদিও সাহসী লোক, কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে তারও প্রাণ উড়ুউড়।
হাবুর বাঘ দুর্গন্ধ ছাড়তে ছাড়তে এসে নোংরা মুখে অয়স্কান্তর। গা কল, গাল চেটে দিল। গরগর করে আদর জানাল।
হাবু অয়স্কান্তকে বলল, “দ্যাখো দারোগাবাবু, আমার সঙ্গে টক্কর দিতে চাইলে কিন্তু জান কবুল করে কাজে নামতে হবে। এ তো কেবল বাঘ দেখছ, আমার হাতিকে তো এখনো দেখনি! তাছাড়া আর যারা আছে তারা আরো ভয়ের সামগ্রী। কাঁচাখেগো অপদেবতা সব। চাকরি করতে এসেছ, চোখ বুজে চাকরি করে যাবে। মাস-মাইনে পেয়ে খাবে-দাবে ফুর্তি করবে, কেউ কিছু বলবে না। যদি কাজ দেখাতে চাও তবে কিন্তু বিপদের জন্য তৈরি থেকো।”
ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট বাঘের গায়ের ডোরা দেখা যাচ্ছে। বিটকেল গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। শ্বস গায়ে পড়ছে। অয়স্কান্তর নিজের চোখে দেখা, হাত দিয়ে ছোঁয়া ব্যাপার। কোনো ভুল নেই।
অয়স্কান্ত কথা বলতে গেল, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না। নড়তে গিয়ে দেখে হাত পা আড়ষ্ট।
হাবু মুচকি হেসে বাঘটাকে সরিয়ে নিয়ে বলল, “আমি হলাম এ-তল্লাটের রাজা বলো রাজা, সদার বলো সদার, ভগবান বলো ভগবান। সবাই আমাকে একবাক্যে মানে। এরপর থেকে তুমিও মেনো।”
. সেই রাতেই অয়স্কান্ত উদভ্রান্তের মতো এসে রাম কবিরাজের কাছে হাজির। বলে, “কবিরাজমশাই, হাবু মানুষ নয়!”
সব শুনে রাম কবিরাজ ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেন। তারপর একটা খুব বলকারক পাঁচন অয়স্কান্তকে খাইয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি আগে একটু ধাতস্থ হও, তারপর অন্য কথা হবে?”
রাম কবিরাজ এমন সব আশ্চর্য পাঁচন তৈরি করতে পারেন, যা খেলে মানুষ-কে-মানুষ পর্যন্ত পাল্টে যায়। রাম কবিরাজের সেই পাঁচন খেয়ে অয়স্কান্তর ডোম্বল-ডোম্বল ভাবটা ঘন্টাখানেক পর কেটে গেল। তবু সে বলতে লাগল, “না কবিরাজমশাই, মিরাকলের সঙ্গে লাগতে যাওয়া ঠিক নয়। মানুষ যত পাজি বদমাশ হোক, তাকে ঢিট করতে ভয় পাই না। কিন্তু হাবু তো ঠিক মানুষ নয়।”
তা, তা-ই হল। অয়স্কান্ত বদলি নিয়ে চলে গেল। এল আর-এক তেজী দারোগা গদাধর।
গদাধর খুবই মজবুত চেহারার মানুষ। এক সময়ে নামকরা কুস্তিগীর ছিল। বয়সও বেশি নয়। তার আবার একটা বিশাল জামান শেফার্ড কুকুর ছিল।
গদাধর আসবার পরই গঞ্জের লোক বলাবলি করতে লাগল, হাবুর বাঘের জন্য নতুন পাঁঠার আমদানি হয়েছে! ছেলেরা ছড়া কাটতে লাগল, “গদাই দারোগা, হয়ে যাবে রোগা।”
গদাধরের কানে সবই গেল। হাবুর গুণকীর্তির কথাও সে এখানে আসবার আগেই শুনে এসেছে। গঞ্জে পা দিয়ে সে খুব বেশি কেরানি দেখানোর চেষ্টা করল না।
রাম কবিরাজের কাছে একদিন গভীর রাতে চুপি-চুপি এসে গদাই দারোগা বলল, “আমি আপনার কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা জানতে চাই।”
রামবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “জেনে লাভ কী? কেউ কিছু করতে পারবে না। অনেকেই গঞ্জের বাস উঠিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে।”
তখন গঞ্জে আবার নতুন নিয়ম চালু করেছে হাবু। তার বাঘের খোরাকি বাবদ প্রতিদিন একজন করে গৃহস্থকে পাঁঠা, ছাগল বা কুকুর দিতে হয়। বাঘেরা নাকি কুকুরের মাংস খেতে খুব ভালবাসে। সেজন্য গঞ্জে যত রাস্তার কুকুর ছিল সব লোপাট হয়ে গেছে প্রায়! ওদিকে গোঁসাইবাগানে মিস্তিরি লাগিয়ে হাবুর জন্য প্রাসাদ তৈরি হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ হাবুর তখন ভরভরন্ত অবস্থা।
গদাই দারোগা বলে, “আমি যে খুব কাজের লোক, তা বলছি না। তবে সাবধানী লোক। সব শুনেটুনে তারপর যদি কিছু করা যায় তা দেখব। আমাকে স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে পাঠানো হয়েছে এখানে।”
রাম কবিরাজ খুব আশ্বস্ত হলেন না। তবু সবই খোলসা করে বললেন। আর সাবধান করে দিলেন এই বলে, “দেখুন, এখানকার লোকজন কিন্তু সবাই হাবুর পক্ষে, কাজেই বিপদে পড়লে তারা আপনাকে সাহায্য করবে না।”
গদাই হেসে বলল, “বেশি লোকের সাহায্য চাই না। আপনার মতো দু-একটা পাকা মাথার তোক সাহায্য করলেই আমার হবে।”
রাম কবিরাজ বুঝলেন, গদাই দারোগা কুস্তিগীর ছিল বটে, কিন্তু তাতে বুদ্ধিটা নষ্ট হয়নি।
যাই হোক, দু-একদিনের মধ্যে হাবু গদাই দাবোগার পিছনে লাগল। একদিন সকালে দেখা গেল, গদাইয়ের অতি আদরের কুকুরটা লোপাট। খোঁজ খোঁজ! অবশেষে কুকুরটার মখমলের মতো গায়ের চামড়াটা পাওয়া গেল গোঁসাইবাগানের কাছে একটা জামগাছের তলায়।
গদাই দিন-তিনেক ভাল করে খেল না, ঘুমোল না। রাম কবিরাজ তাঁকেও একটা ভাল পাঁচন তৈরি করে পাঠিয়ে দিলেন।
গদাই দারোগার কুকুরটাকে মেরে হাবু চালে ভুল করেছিল। কুকুরটা ছিল গদাইয়ের প্রাণ। সেই কুকুরের মৃত্যুতে গদাই দারোগা হয়ে উঠল ‘গদাই বিভীষিকা’।
অবশ্য কয়েকজন জানে, গদাই দারোগার সেই মারমুখো মেজাজের পিছনে কবিরাজমশাইয়ের আশ্চর্য পাঁচনের কাজও আছে। রাম কবিরাজ এমন এক দুর্লভ গাছ-গাছড়ার পাঁচন তৈরি করে গদাধরকে খাইয়েছিলেন যে, তাতে মানুষের শরীরে যেমন দুনো বল হয়, তেমনি তার মেজাজও হয়ে ওঠে টংকার। আবার গায়ের জোর আর বদমেজাজ হলেই হয় না, ঠাণ্ডা মাথার কূটবুদ্ধিও খেলাতে হয়, নইলে হাবুর মতো ধুরন্ধরকে জব্দ করা সোজা নয়। তাই কবিরাজ মশাই আবার পাঁচনে এমন জিনিসও দিয়েছিলেন যে তাতে মাথা ঠাণ্ডা থাকে, বুদ্ধির হাওয়া-বাতাস খেলে।