দাসু যে খুব বাড়িয়ে বলত তা নয়, বাস্তবিক হাবু খুবই বুদ্ধিমান ছেলে ছিল। বখাটে হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সে স্কুলে ফাস্টও হয়েছে।
যাই হোক, হাবুর যখন মোটে চোদ্দ বছর বয়স, তখন সে বাপের সিন্দুক থেকে প্রায় হাজার পাঁচেক টাকা আর মায়ের গয়না চুরি করে উধাও হয়ে যায়। সেই শোকে দাসু আর বেশি দিন বাঁচল না, হাবুর মাও বছর দুই বাদে চোখে ওল্টায়। তার বেশ
কয়েক বছর পর একদল ষণ্ডা-গুণ্ডা চেহারার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হাবু এসে গোঁসাইবাগানে থানা গাড়ল। তার তখন পেল্লায় চেহারা হয়েছে, চোখদুটো সব সময় রক্তবর্ণ, কাউকে গ্রাহ্য করে না। একে মারে, তাকে ধরে, তারটা কেড়ে নেয়। তারপর গঞ্জে এবং আশপাশের এলাকায় খুব চুরি-ডাকাতি আর খুন-খারাবি শুরু হয়ে গেল। সেই এক দুঃস্বপ্ন। কোনো তোক নিশ্চিন্তে রাস্তায় বেরোতে পারে না। সন্ধের পর রাস্তাঘাট নিঃঝুম হয়ে যায়। বাড়িতে থেকেও লোকের প্রাণ ধুকপুক করত।
হাবু নাকি মেলা মন্ত্রতন্ত্র শিখে এসেছে। গোঁসাইবাগানের কুঠিবাড়িতে সে নানারকম সাধনা করে বলে গুজব রটে গেল। অনেকের মুখে রাম কবিরাজ শুনেছেন যে, সন্ধেবেলা হাবুকে নাকি কখনো কখনো একটা প্রকাণ্ড বাঘের পিঠে চড়ে বেড়াতে দেখা গেছে। একজন বলল, সে স্বচক্ষে হাবুকে উড়ে বেড়াতে দেখেছে।
তখন গঞ্জের দারোগা ছিলেন নিশিকান্ত। নিশি দারোগা এক সময়ে খুব দাপটের লোক ছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর বয়স হয়েছে, রিটায়ার করতে যাচ্ছেন, তাই তিনি আর বেশি ঝুট ঝামেলায় যেতেন না। হাবুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েও লোকে ভয়ে থানায় গিয়ে নালিশ করত না। সে সময়ে রাম কবিরাজই উদ্যোগী হয়ে গিয়ে নিশি দারোগাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাজী করিয়েছিলেন।
দিন দুই-তিন পরে নিশি দারোগা একদিন রামবাবুর দোকানে এসে হ্যাঁট খুলে হাঁপ ছেড়ে বললেন, “ওঃ মশাই, কী লোককেই ধরতে পাঠিয়েছিলেন! নাজেহাল করে ছেড়েছে।”
“কী রকম?” বলে রাম কবিরাজ নড়ে বসলেন। “আর বলবেন না। গোঁসাইবাগানে গিয়ে পুরো বাড়িটা ঘেরাও করে রেইড করেছিলাম। তখন হাবু আর তার দলবল বাড়ির ভিতরেই ছিল। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে দেখলাম সব ভোঁ-ভোঁ, কেউ কোথাও নেই।”
“সে কি?”
“তবে আর বলছি কী? চোখের সামনে অতগুলো লোক একেবারে গায়েব হয়ে গেল মশাই! বাইরে থেকে জানালা দিয়ে স্বচক্ষে দেখেছি, হাবুকে ঘিরে দশ বারোটা লোক বসে গাঁজা টানছে। ভাল করে বাড়িটা ঘিরে বাঁশি ফুকে রিভলবার-বন্দুক বাগিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে চেঁচিয়ে বললাম, হাবু, সারেন্ডার কর শিগগির! কিন্তু কাকে বলা? ঘরে হাবু আর তার স্যাঙাতদের চিহ্নও নেই। গুপ্ত কুঠুরি বা সুড়ঙ্গ আছে কিনা অনেক খুঁজে দেখলাম, কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না। একেবারে তাজ্জব ব্যাপার।”
শুনে রাম কবিরাজ ঘন-ঘন তামাকের নলে টান দিয়েছিলেন সেদিন। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল।
সেই থেকে হাবু গুণ্ডার নামে সম্ভব-অসম্ভব আরো সব গুজব রটতে লাগল। হাবু নাকি ভূত পোষে, মন্ত্রের জোরে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, যে-কোনো মানুষকে চোখের দৃষ্টি দিয়ে হাওয়া করে দিতে পারে। হাবুর ভয়ে তখন সবাই থরহরি কম্প।
রাম কবিরাজ মন্ত্র-তন্ত্র বা ভূতপ্রেত মানেন। কিন্তু এসব বুজরুকিতে তাঁর বিশ্বাস নেই। তিনি জানেন, খারাপ লোক যতই মন্ত্রতন্ত্র জানুক আর যতই ক্ষমতাবান হোক, শুভবোধ এবং মঙ্গলের দ্বারা তাদের পতন ঘটবেই।
সেই থেকে রাম কবিরাজ নানা মতলব ভেঁজেছেন। হাবু অবশ্য রাম কবিরাজের এসব মতলব টের পায়নি। পেলে এসে হামলা করত।
নিশি দারোগা রিটায়ার করে চলে গেলে সে জায়গায় এক অল্পবয়সী এবং খুব তেজী দারোগা এল। তার নাম অয়স্কান্ত। মহা কাজের মানুষ।
সে গঞ্জে পা দিয়েই হাবু গুণ্ডার কথা শুনেছে। হাবু তখন সদ্য হরিহরপুরের জমিদারবাড়ি লুট; একটা ব্যাংক ডাকাতি আর দুটো বড় ধরনের চুরি করেছে। তাছাড়া খুন-জখম তো ছিলই। কিন্তু কেউ তার নামে নালিশ করতে যায় না ভয়ে। তার ওপর হাবুর বদনাম হওয়ার বদলে তার বেশ সুনামই হচ্ছিল। তার অলৌকিক ক্ষমতা, তার সাহস আর তার নামে প্রচলিত গালগল্প শুনে অনেকেই হাবুকে মনে-মনে পুজো করত। বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেরা তখন নিজেদের মধ্যে ‘হাবু-হাবু’ খেলে। একটু বড় বয়সের ছেলে-ছোঁকরারা অনেকেই তখন হাবুর দলে ভিড়বার জন্য গোসাঁইবাগানের কাছে গিয়ে ঘুরঘুর করে।
রাম কবিরাজ এবং তাঁর মতো আর যাঁরা সৎ আর স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন, তাঁরা দেখলেন, সমূহ সর্বনাশ! এরপর হাবুর খ্যাতি এত বেড়ে যাবে যে, পুলিসও তাকে ধরতে সাহস করবে না। অধর্মেরই জয় হয়ে যাবে। হাবুরও অহংকার আর বেয়াদপি খুব বেড়ে গেছে। সে রাজা-বাদশার মতো চলাফেরা করে। রাস্তার লোক তাকে দেখলে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়, বাজার-হাটে লোকে তাকে নমস্কার করে, একটু কথা বলতে পারলে বর্তে যায়।
অয়স্কান্তও কিন্তু খুব অহংকারী লোক। সে জানত, মফস্বল শহরে দারোগার ওপর আর কেউ নেই। সবাই বরাবর দারোগাকেই খাতির করে এসেছে। তাই হাবুর এত খাতির অয়স্কান্ত সহ্য করবে কেন? ব্যাপারটা তার সম্মানে খুব ঘা দিল।
তা, অয়স্কান্ত যখন হাবুকে জব্দ করার নানারকম ফন্দিফিকির আঁটছে, তখন একদিন এক অবাক কাণ্ড।