কবিরাজমশাই বললেন, “খুব আছে, খুব আছে। হাবুর মামলায় তুমি হাকিম ছিলে, আমি সাক্ষী দিয়েছিলাম। বারো-চোদ্দ বছর আগেরকার কথা, মনে থাকবে না কেন?”
মন্মথবাবু আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমি হাবুকে যাবজ্জীবন কয়েদের রায় দিয়েছিলাম।”
“তাও জানি। খুব ভাল কাজ করেছিলে। হাবুর মতো বদমাশ দুটো হয় না। কত যে খুন করেছে এ মহকুমায়, তার ঠিক নেই।”
মন্মথবাবু চিন্তিত সুরে বলেন, “সে ঠিক। কিন্তু জেল হওয়ার পর নাকি হাবু রোজ সকালে গীতা পাঠ করত, সন্ধ্যা-আহ্নিক করত, একাদশী-পূর্ণিমায় উপোস দিত। জেলখানায় তার চরিত্রের খুব সুনাম হয়, সবাই তাকে সাধুবাবা বলে ডাকত। এমন কি, পুলিস জেলার পর্যন্ত সবাই তাকে সম্মানও করতে শুরু করে।”
“সেও কানাঘুষোয় শুনেছি।”
মন্মথবাবু আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কিন্তু সব ভাল যার শেষ ভাল।”
“তার মানে?”
“এই দেখ না!”
বলে মন্মথবাবু তাঁর চাঁদরের তলায় হাত দিয়ে পাঞ্জাবির বুক। পকেট থেকে একটা খাম বের করে কবিরাজ মশাইয়ের হাতে দিলেন।
রামবাবু ভ্রূ কুঁচকে চিঠিটা পড়তে লাগলেন। “শ্রীশ্ৰীকালীমাতা সহায়। মাননীয় মহাশয়, পত্রে আমার নমস্কার জানিবেন। বিধিমতো আপনার বরাবর নিবেদিন করিতেছি যে, আমাদের পরম মাননীয় হাবু ওস্তাদ আগামী দোলের আগের দিন খালাস পাইতেছেন। হাবু ওস্তাদের প্রতি আপনি যে নিষ্ঠুর সাজার বিধান দিয়াছিলেন, তাহা আমরা ভুলি নাই। শ্ৰীশ্ৰীকালীমাতার নামে শপথ করিতেছি, হাবু ওস্তাদ খালাস হইবার সাত দিনের মধ্যে আমরা চরম প্রতিশোধ লইব। প্রস্তুত থাকিবেন। ইতি হাবু ওস্তাদের ভক্তবৃন্দ।”
চিঠি পড়া শেষ করে কবিরাজমশাই বলেন, “কবে পেলে চিঠিটা?”
“আজকের ডাকেই এল।” রাম কবিরাজ একটু নিশ্চিন্তের হাসি হেসে বললেন, “ভয় পেয়েছ নাকি?”
মন্মথবাবু উদাস স্বরে বলেন, “ভয়ের আর কী! বুড়ো হয়েছি, এখন মরার ভয় বড় একটা নেই। তবে কিনা এ-লোকগুলো তো ভাল নয়। এদের হাতে যদি অপঘাতে প্রাণ দিতে হয়, তবে আর পরকালে গতি হবে না।”
রাম কবিরাজ হাঃ হাঃ করে ভরাট গলায় হেসে বললেন, “গতি হবে না তো হবে না, দুজনে অপঘাতে মরে নাহয় গিয়ে গোঁসাইবাগানে ভূত হয়ে থাকব আর দেদার আড্ডা মারব। গোসাঁইবাগান জায়গাও ভাল, ভারি নিরিবিলি, লোক চলাচল নেই, সেখানে গাছ-গাছড়াও প্রচুর। ভূতদের রোগ-ভোগ সারাতে গাছ-গাছড়া তুলে ওষুধ বানাব মনের আনন্দে। প্র্যাকটিস ভালই জমবে। তুমিও গিয়ে হাকিমি করতে পারবে।”
যেই রাম কবিরাজ এ কথা বলেছেন, অমনি দোকানঘরের মধ্যে যেন ছোট্ট একটা ঘূর্ণিঝড় খেলে গেল। শিশি-বোতলগুলো নড়ে উঠল খটাখট করে।
রাম কবিরাজ একটু অবাক হয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলেন। মন্মথবাবুও সচকিত হয়ে বললেন, “ঝড় ছাড়ল নাকি?”
রামবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “আরে না! শীতকালে ঝড় আসবে কোত্থেকে? বোধ হয় উত্তরে বাতাসের একটা ঝাঁপটা এল।”
মন্মথবাবু আরো খানিকক্ষণ বসে থেকে বলেন, “রাত হল হে! এবার উঠি।”
“বোসো। তামাক সাজি।”
মন্মথবাবু বসেন। রাম কবিরাজ উঠে দোকানঘরের পিছনে ছোট্ট কুঠুরিতে তামাক সাজতে বসেন। কলকে সাজিয়ে ফুঁ দিতে দিতে সামনের দোকানঘরে এসে গড়গড়ার মাথায় বসিয়ে নলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “নাও হে।”
তারপর অবাক হয়ে দেখেন গড়গড়ার নল যার দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন, সেই লোকটাই নেই!
“গেল কোথায় মন্মথ?” আপনমনে এই কথা বলে রাম কবিরাজ চেয়ারে বসে অন্যমনে তামাক খেতে লাগলেন। চারদিকটা খুব নিঃঝুম হয়ে এসেছে। বাজারের দোকানপাট সবই প্রায় ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। ছোট গঞ্জ-শহরে এমনিতেই লোক কম, তার ওপর বেজায় শীতের রাত্রি। খামোখা লোকে ঘরের বাইরে থাকতে চায় না।
রাম কবিরাজের অবশ্য শীত, বাঘ, ভূত–কাউকেই ভয় নেই। বুড়ো হলেও ভারি ডাকাবুকো লোক। বসে বসে রামবাবু হাবু গুণ্ডার কথা ভাবছিলেন।
৪. রাম কবিরাজ হাবুর সবকিছুই জানেন
রাম কবিরাজ হাবুর সবকিছুই জানেন। এই গঞ্জে তাকে শিশুবেলা থেকে বড় হতে দেখেছেন। দাসু রায়ের বড় আদরের একমাত্র ছেলে ছিল হাবু। বাবা-মার অত্যধিক আদর আর প্রশ্রয় পেয়ে অল্প বয়স থেকে বিগড়ে যায়। ইস্কুল পালিয়ে গোসাঁইবাগানে গিয়ে বখা ছেলেদের সঙ্গে বিড়ি ফুঁকত। তাই দেখে একদিন রামবাবু গিয়ে দাসু রায়কে বলেছিলেন, “ছেলেটার দিকে নজর দাও হে দাসু! বিড়ি ফুঁকতে শিখেছে যে!” দাসু কিন্তু পুত্রস্নেহে অন্ধ। খেঁকিয়ে উঠে বলল, “যাও, যাও, নিজের কাজ করো গে যাও। আমার ছেলে তেমন নয় মোটেই। লোকে হিংসে করে যা-তা রটিয়ে বেড়াচ্ছে।”
একমাত্র ছেলে বলে হাবুর কোনো অভাব রাখত না দাসু। মাসে মাসে ওইটুকু ছেলেকে দশ-পনেরো টাকা করে হাতখরচ পর্যন্ত দিত। সেই টাকা পেয়ে হাবু আরো বিগড়োতে থাকে। ঘুড়ি, লাটাই, লাটু, লজেন্স দেদার কিনেও টাকা ফুরোত না। প্রায়ই বখাটে বন্ধুদের সঙ্গে ফিষ্টি করত, যাত্রা-সিনেমা দেখে বেড়াত। খুব ফুর্তিবাজ হয়ে গেল অল্প বয়সেই, ক্লাসের পরীক্ষায় গোল্লা পেয়ে বাসায় ফিরে কাঁদতে বসত। সেটা অবশ্য মায়াকান্না। ছেলের চোখে জল দেখে তার বাবা-মা এসে হাবুকে পারলে কোলে তুলে সান্ত্বনা দেয়। দাসু বলে বেড়াত, “আমার ছেলের মতো বুদ্ধিমান ছেলে দুটো নেই। কিন্তু পড়তে বসলেই তার চোখ ব্যথা করে। ভাবছি চোখের ডাক্তার দেখাব। সামনের বছর হাবু ক্লাসে ফার্স্ট হবে।”