বুরুন ভারি বিরক্ত বোধ করে। এ জায়গাটাকে সে নিরিবিলি আর নির্জন বলে ভেবেছিল। এখন দেখল মোটেই তা নয়! চারদিকে খুব হতাশভাবে তাকিয়ে সে আবার একটা শিশুগাছে উঠে ডাল বেয়ে-বেয়ে ফিরে যেতে লাগল।
মেজাজটা আজ তার সত্যিই খারাপ।
৩. বুরুনের দাদু রাম কবিরাজ
সন্ধের পর বুরুনের দাদু রাম কবিরাজ তাঁর দোকান-ঘরে বসে আছেন। হাড়-কাঁপানো শীত পড়েছে এবার। সূর্য ডোবার পর
আর রাস্তায় বড় একটা লোক-চলাচল নেই। বাজারও অর্ধেক বন্ধ। খদ্দেরের আনাগোনা খুবই কম। শুধু কবিরাজমশাইয়ের দোকানে নিত্যকার আড্ডাধারীরা এসেছে।
আড্ডাধারীরা সবাই বুড়ো-সুড়ো মানুষ। গায়ে আলোয়ান, মাথায় বাঁদুরে টুপি, গলায় কমফটার, পায়ে মোজা চাপিয়ে সব ঝুম্বুস হয়ে বসে আছেন। টেবিলের ওপর একটা লক্ষ জ্বলছে।
রাম কবিরাজ বললেন, “আমার নাতি বুরুন এবার অঙ্কে তেরো পেয়েছে, জানো তো সবাই!”
সবাই একবাক্যে বলে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব জানি।”
রামবাবু দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, “তা আর জানবে না! ছেলের বাপ যে সারা শহরে ঢোল সহরত করে সে কথা লোককে জানিয়েছে। কিন্তু আমি বলি বাপু, অঙ্কে তেরো পেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়! যারা বিদ্বান বুদ্ধিমান, তাদের অবস্থা তো দেখছি। এই ধরো না কেন, আমার ছেলে ভেলু তো সোনার মেডেল পেয়ে পাশ করা ডাক্তার, নামডাকও খুব। কিন্তু এখনো রুগির নাড়ী ধরে বলে দিতে পারবে না, রুগির পেটের ব্যামো না বুকের ব্যথা, রুগি রাগী না বেকুব। সেসব বোঝা কি সোজা কথা! তবু গলায় নল ঝুলিয়ে হাতে চুঁচ বাগিয়ে মানুষ মেরে বেড়াচ্ছে। আমি বলে দিচ্ছি, নাতিকে কবিরাজি শেখাব। অঙ্কে তেরো পেয়েছে তো কুছ পরোয়া নেই, অবিদ্যা শেখার চেয়ে মুখ থাকা ভাল।”
সবাই সায় দিয়ে ওঠেন, “তা বটে! তা বটে!”
সায় না দিয়ে উপায়ও নেই। রাম কবিরাজকে সবাই ভয় পায়। ভারি সৎ, তেজী আর আদর্শবাদী লোক।
রাম কবিরাজ নাতির পক্ষ হয়ে আরো কী বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক এই সময়ে রিটায়ার্ড সাব জজ ধীরেন চাটুজ্যে হাতে ছাতা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
ছাতা দেখে সবাই অবাক।
মহিমবাবু বলে উঠলেন, “ধীরেন যে আজ বড় ছত্রপতি সেজে এসেছ। বাইরে বৃষ্টি-বাদলা হচ্ছে নাকি?”
ধীরেনবাবু হাঁফ ছেড়ে বললেন, “আরে না। ছাতাটা একটা অস্ত্ৰবল।”
“অস্ত্রবল? কিসের অস্ত্রবল হে? অস্ত্রের কথা ওঠে কেন?”
“ওঠে, ওঠে।” বলে ধীরেনবাবু একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে গলাবন্ধ কোটের ওপরের কয়েকটা বোম খুলতে খুলতে বললেন, “দিনকাল ভাল নয় হে। এই গঞ্জে যে বাঘ বেরিয়েছে, সে-খবর রাখো?”
“বাঘ?”
“বাঘ!”
“বাঘ!” সকলের একবাক্যে প্রশ্ন। ধীরেনবাবু বললেন, “গল্প শুনেছিলাম, এক সাহেব ছাতা হাতে জঙ্গলের ধারে বেড়াতে গিয়ে বাঘের মুখোমুখি পড়ে যায়। বুদ্ধি করে তখন সাহেবটা বাঘের মুখের সামনে পটাং করে ছাতাটা খুলে ধরতেই বাঘ ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। তাই ছাতাটা নিয়ে বেরিয়েছি আজ।”
রাম কবিরাজ ধমক দিয়ে বললেন, “ধানাই-পানাই ছেড়ে আসল কথাটা বলবে তো! বলি বাঘ কোথায়?”
“আর বলো কেন! বিকেলের দিকে একটু হায়পাথার চা-বাগানের দিকে নিরালা মাঠের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম আজ। সঙ্গে নাতি। তা হঠাৎ নাতি বায়না ধরল, কুকুরের বাচ্চা নেবে। চেয়ে দেখি মাঠের মধ্যে চার-পাঁচটা কুকুরছানা খেলা
করছে। নাতির বায়নায় অবশেষে কুকুরছানা ধরতে মাঠে নামতে হল। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি, ও বাবা! কুকুরছানা কোথায়? চার-পাঁচটা বাঘের বাচ্চা এ ওর গায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে দিব্যি খেলছে!”
“ঠিক দেখেছ যে সেগুলো বাঘের বাচ্চা?” ধীরেনবাবু দৃঢ় স্বরে বললেন, “একেবারে রায়বাঘা। চিতা বা গেছো বাঘ নয়, গায়ে-ডোরাকাটা দক্ষিণ রায়। সেই দেখে তো আমি নাতিকে পাঁজাকোলে নিয়ে দে ছুট, দে ছুট। বাঘের বাচ্চা যখন দেখা গেছে, তখন মা বাঘ বা বাবা বাঘও কাছেপিঠেই আছে। সবাই খুব সাবধানে থেকো হে!”
হেমবাবু উঠে জুতো পরতে পরতে বললেন, “আমি বরং রওনা দিই। দিগিন আমাকে একটু এগিয়ে গিয়ে আসুক।”
বাকি সবাইও উশখুশ করতে থাকেন। উপেনবাবু আপন মনে “রাম রাম” করছিলেন শুনে শশধরবাবু তাঁর ভুল ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “ও তো ভূতের মন্ত্র! বাঘ কি আর রাম-নাম শুনে পালায়?”
“তবে?” উপেনবাবু জিগ্যেস করেন।
রামবাবুর ভয়ডর নেই। নিশ্চিন্ত মনে বললেন, “তা বাঘের নামে ভয় পেলে চলবে কেন। উত্তরবাংলার এসব অঞ্চলে তো বাঘ বেরোবেই। গত বছরও বেরিয়েছিল। তবে শহরের মাঝখানে আসে না।”
সবাই বলে ওঠে, “তা বটে! তবে কিনা–”
আড্ডাধারীরা আজ আর বেশিক্ষণ বসলেন না। চক্ষুলজ্জায় খানিকক্ষণ বসে থেকে, সব দল বেঁধে উঠে পড়লেন। গেলেন না শুধু মন্মথবাবু।
রামবাবুর ভয়ডর নেই। সবাই চলে যাওয়ার পরেও নিশ্চিন্ত মনে বসে রইলেন। রুগি-টুগি বড় একটা কবিরাজের কাছে আসতে চায় না। তারা মরতে-মরতে গিয়ে ভিড় করে তাঁর ছেলে ভেলুর চেম্বারে। তবু রাম কবিরাজ ধৈর্য ধরে বসে থাকেন। সত্তরের ওপর বয়স হল, তবু এখনো তিনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভয়ংকর আশাবাদী।
মন্মথবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “আর যাওয়া! বাঘের ভয় করি না হে! এখন তার চেয়ে অনেক বড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে।”
“কীরকম?”
“হাবু গুণ্ডার কথা তোমার মনে আছে?”