“ও।” বুরুন বলে।
লোকটা বিরক্ত হয়ে বলে, “কী ব্যাপার তোমার বল তো! এবারও যে বড় ভয় পেলে না?”
বুরুন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আপনার মাথায় উকুন হয়েছে আর চুলকোচ্ছে বলে আমার ভয় পাওয়ার কী?”
লোকটা রেগে গিয়ে বলে, “তুমি ভাবছ আমি তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছি?”
“তা ভাবব কেন?”
লোকটা কটমট করে খানিক বুরুনকে দেখে নিয়ে বলে, “ভাবছ ম্যাজিক করছি?”
“হতে পারে।”
লোকটা হঠাৎ ডান হাতটা ওপর দিকে তুলল। বুরুন দেখল, হাতটা লম্বা হয়ে একটা চালতা গাছের মগডালে চলে গেছে। পরমুহূর্তে একটা পাকা চালতা পেড়ে এনে লোকটা সেটা বুরুনের সামনে ফেলে দিয়ে বলল, “দেখলে?”
বুরুন বিরক্ত হয়ে বলে, “না দেখার কী? চোখের সামনেই তো পাড়লেন।”
লোকটা ধমকে উঠে বলে, “তবে ভয় পাচ্ছ না যে!”
“ভয় না পেলে কী করব?” এই বলে বুরুন থোকা থেকে কয়েকটা কুল ছিঁড়ে মুখে ফেলল।
লোকটা ভারি আঁশটে মুখ করে বলে, “লজ্জা করছে না কুল খেতে? চোখের সামনে জলজ্যান্ত আমাকে দেখতে পেয়েও নিশ্চিন্ত মনে কুল খাওয়া হচ্ছে? আরো দেখবে? অ্যা।”
বলে লোকটা হঠাৎ ডান হাত দিয়ে নিজের বাঁ হাতটা খুলে নিয়ে চারদিকে তলোয়ারের মতো ঘোরাতে লাগল; তারপর বাঁ হাত দিয়ে ডান হাত খুলে নিল। দুটো পা দু হাতে খুলে নিয়ে দেখাল। তারপর এবার অদৃশ্য হয়ে ফের হাজির হল। তেরো-চোদ্দ ফুট লম্বা হয়ে গেল, আবার হোমিওপ্যাথির শিশির মতো ছোট্ট হয়ে গেল। এসব করে হাঁফাতে-হাঁফাতে আবার আগের মতো হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখলে?”
“হুঁ!”
“হুঁ মানে? এ-সব দেখার পরও মূর্ছা যাচ্ছ না যে! দৌড়ে পালাচ্ছ না যে! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুল খেয়ে যাচ্ছ যে বড়! আমি কে জানো?”
“কে?”
“আমি গোসাঁই ডাকাতের বড় স্যাঙাৎ নিধিরাম। দুশো বছর ধরে এখানে আছি, বুঝলে? দুশো বছর।”
“বুঝলাম।”
“কী বুঝলে?”
বুরুন বিরক্ত হয়ে বলে, “এসব তো সোজা কথা। বোঝাবুঝির কী আছে! আপনি দুশো বছর ধরে এখানে আছেন।”
লোকটা একটু গম্ভীর হয়ে বলে, “তুমি বাপু তলিয়ে বুঝছ না। দুশো বছর কি কোনো মানুষ বেঁচে থাকে, বলো!”
“তা থাকে না।”
“তবে আমি আছি কী করে?”
“থাকলে আমি কী করব?”
লোকটা রেগে উঠে বলে, “তবু তুমি তলিয়ে বুঝছ না কিন্তু। আমি আসলে বেঁচে নেই।”
বুরুন আর একটা কুল মুখে দিয়ে বলে, “তাতে আমার কী?”
“ওঃ, খুবই চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছ যে! ভূতকে ভয় পাও না, কেমনতরো বেয়াদব ছেলে হে তুমি!”
বুরুন বলল, “ভয় লাগছে না যে।”
এই কথা শুনে লোকটার চোয়াড়ে মুখটা ভারি করুণ হয়ে গেল। অসহায়ভাবে ছলছলে চোখে চেয়ে রইল বুরুনের দিকে। ফোঁত করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “একটুও ভয় লাগছে না?”
“না।”
নিধিরাম হাতের পিঠে চোখের জল মুছল বোধহয়। মনের দুঃখে তার নাকের ডগা কাঁপছিল। চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, “তুমি আমাকে বড় মুশকিলে ফেললে দেখছি। এখন নিজেদের সমাজে আমি মুখ দেখাব কেমন করে বলো তো! গোঁসাই সদার শুনলে আমার গদান যাবে।”
বুরুন একটা ফুঃ শব্দ করে বলে, “আপনার আবার গদান যাওয়ার ভয়! মুণ্ডুটা তো একটু আগে ফুটবলের মতো হাতে ধরে রেখেছিলেন।”
লোকটা দুঃখের সঙ্গে বলে, “আমাদের নিয়ম অন্যরকম। কেউ যদি কোনো দোষ করে, তাহলে গোসাঁইবাবা তার মুণ্ডু কেড়ে রেখে দেন। তোমরা বলো ‘লজ্জায় মাথা কাটা গেল’; সে হল কথার কথা। আসলে তো আর মাথা কাটা যায় না। কিন্তু আমাদের সত্যি-সত্যিই মাথা কাটা যায়। আমাদের সমাজে সে বড় লজ্জার ব্যাপার। তুমি কি একটু চেষ্টা করে দেখবে নাকি খোকা, যদি একটু ভয়-টয় করতে পারো!”
বুরুন বলল, “না, সে হওয়ার নয়! আজ আমার মনটা ভাল নেই। মেজাজ খারাপ থাকলে আমার ভয়ডর থাকে না।”
লোকটা খুব আশান্বিত হয়ে বলে, “কেন, কেন, তোমার মন খারাপ কেন বলো তো! আমি তোমার মন-মেজাজ ভাল করবার জন্যে যা করতে বলবে তা-ই করব। কিন্তু কথা দিতে হবে যে, আমাকে একটু ভয় করবে।”
বুরুন নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “সে হওয়ার নয়। আমি অঙ্কে তেরো পেয়েছি।”
লোকটা এক গাল হেসে বলে, “এই কথা। তা আমি তোমাকে সব অঙ্ক শিখিয়ে দেব। নয়তো পরীক্ষার সময় অদৃশ্য হয়ে গিয়ে তোমার অঙ্ক কষে দিয়ে আসব। তাহলে এবার একটু ভয় খাও,
অ্যাাঁ! লক্ষ্মী সোনা ছেলে!”
বুরুন আবার গুটি চারেক কুল মুখে দিয়ে বলে, “ভূতের কাছে। কেউ অঙ্ক শেখে? আমি আঁক শিখব করালী স্যারের কাছে।”
লোকটা খুব ভাবিত হয়ে বলে, “তাই তো! বড় বিপদ দেখছি। তোমার মন-মেজাজ ভাল করতে না-পারলে তো তুমি কিছুতেই ভয় পাবে না তাহলে। শোনোখোকা, আমি কিন্তু আরো কাণ্ড জানি। এক্ষুনি এমন মন্ত্র বলব যে শোঁ শোঁ করে ঝড় এসে যাবে, বিড়বিড়িয়ে শিলাবৃষ্টি পড়বে, কিংবা চাও তো দিনের আলোয় ঘোর অমাবস্যার অন্ধকার নামিয়ে আনতে পারি। সেই অন্ধকারে কঙ্কাল আর কবন্ধরা চারিদিকে ধেই-ধেই করে নাচবে।”
বুরুন অবহেলাভরে বলে, “যা খুশি করুন না, বারণ করছে। কে?”
“তবু ভয় পাবে না?”
“না।”
লোকটা মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে চোখের জল মুছতে মুছতে আপন মনে বলতে থাকে, “গোঁসাই বাবা আমাকে নীচের পোস্টে নামিয়ে দেবে, মাথা কেড়ে রেখে দেবে, কেউ আমাকে আর ভক্তি-শ্রদ্ধা করবে না।”
চারদিকে গাছ-গাছালি থেকে অশরীরীরা এতক্ষণ চুপচাপ কাণ্ড-কারখানা দেখছিল। এবার সবাই সুর করে বলে উঠল, “নিধিরাম দুয়ো! নিধিরাম দুয়ো! নিধিরাম দুয়ো!”