একমাত্র উপায় হচ্ছে টারজানের মতো বড় গাছে উঠে এক গাছ থেকে ডাল ধরে ঝুল খেয়ে অন্য গাছের ডাল ধরে এগিয়ে যাওয়া। যদি গাছ থেকে পড়ে যায় তো যাবে। সেটা এমন কিছু দুঃখের হবে না তার কাছে। বরং বাড়ির লোক ভাববে, আহা, বুরুনকে আমরা কত কষ্ট দিয়েছি।
গাছ বাইতে বুরুন ওস্তাদ। একটা শিরীষ গাছে সে বানরের মতো উঠে গেল। মাটির সঙ্গে সমান্তরাল একটা মোটা ডালের ওপর দিয়ে সে খানিক হেঁটে খানিক হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে পরের কদম গাছটার একটা ডাল ধরে ফেলল। মাটি থেকে প্রায় ত্রিশ হাত উঁচুতে। এগিয়ে যেতে তেমন কোনো বাধা হচ্ছিল না বুরুনের। কেউ কোথাও নেই। শুধু শীতের কনকনে বাতাস বইছে। রোদের রঙে লালচে আভা। গাছ-গাছালিতে অজস্র পাখি আর পতঙ্গের ওড়াউড়ির শব্দ।
গাছের ডালের ঘষায় হাত-পায়ের নুনছাল উঠে গিয়ে জ্বালা করছে। একটা নিমগাছে বসে বুরুন একটু জিরোলো। তারপর আবার ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। পরিশ্রমে এই শীতেও ঘাম হচ্ছে। যত এগোচ্ছে, তো গাছপালা ঘন হচ্ছে। একেবারে গায়ে গায়ে সব গাছ। একটার ডালপালা অন্যটার ডালপালায় ঢুকে গেছে। এখন আর এক গাছ থেকে অন্য গাছে যেতে কষ্ট নেই। এক-একটা গাছে হেঁটমুণ্ডু হয়ে বাদুড়েরা ঝুলে আছে। কাঠবেরালী ডুমুর খাচ্ছে বসে। নীচের জঙ্গলে খড়মড় শব্দ করে একটা শজারু চলে গেল। বহু পাখির বাসা পার হল বুরুন। তার কোনোটাতে
পাখির ডিম রয়েছে, কোনোটায় কুষি কুষি পাখির ছানা তাকে দেখে আতঙ্কে কিচমিচ করে ওঠে।
কুলগাছের কুঞ্জবনে পৌঁছতে বুরুনের কষ্ট হল বটে, কিন্তু এ কাজ যে সে ছাড়া আর কেউ কখনো করতে পারেনি, তা ভেবে খুব একটা বাহাদুরির ভাবও এল মনে। একটা শিশু গাছের গা বেয়ে সে নীচের নিস্তব্ধ, নির্জন অন্ধকার জায়গাটায় আস্তে-আস্তে নামতে থাকে। নামবার মুখে ধরবার মতো নিচু ডাল ছিল না বলে তাকে প্রায় দশ হাত উঁচু থেকে লাফ দিয়ে নামতে হল। তবে নীচে পচা পাতার স্তূপ জমে গদির মতো হয়ে আছে, তাই বুরুনের ব্যথা লাগল না। ভুস করে পা দুটো ডেবে গেল শুধু, আর তলায় একটা কাঁটা বা কাঁচ যাই হোক তার পায়ে প্যাট করে বিঁধে গেল।
একটু ফাঁকায় এসে বুরুন মাটিতে বসে পায়ের তলাটা দেখছিল। তেমন কিছু নয়, একটা শামুকের ভাঙা খোল বিধেছে। তবে এসবে অভ্যাস আছে তার। শামুকের টুকরোটা বের করে একমুঠো দুব্বো তুলে ঘষে রসটা লাগিয়ে দিল। এ ওষুধ তার দাদুর শেখানো। দুব্বোর রসে অনেক অসুখ সারে, অনেক বিষ নষ্ট হয়।
দাদু তাকে অনেক কিছু শেখায়। মানুষের শরীরে রোজ এক রকমের বিষ তৈরি হচ্ছে, তাকে বলে টকসিন। এই বিষ জমে-জমে শরীরে নানা রোগের সূচনা করে। মাছ-মাংস খেলে টকসিনের পরিমাণ আরো বাড়ে। সেজন্য দাদু রোজ সকালে তাকে থানকুনি পাতার রস একটু আখের গুড় আর দুধ দিয়ে খাইয়ে অনেকখানি জল গিলিয়ে দেয়। তাতে টকসিন জমতে পারে না শরীরে। দাদু মাছ-মাংস খাওয়ার ঘোর বিরোধী। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে দাদুর প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। বাবা বলেন, প্রোটিনের জন্য মাছ-মাংস অতি প্রয়োজন। দাদু বলেন,
পশুপাখির শরীরের কোষ আর মানুষের শরীরের কোষে অনেক গরমিল বাবা। ও খেলে খটামটি লাগবেই।
বুরুন পায়ে ঘাসের রস লাগিয়ে উঠে দাঁড়াল। চারদিকে অসংখ্য গাছে মেঘের মতো ঘনিয়ে আছে থোকা-থোকা বুনো কুল, বন-করমচা। কয়েকটা চালতা গাছ থেকে পাকা চালতার গন্ধ আসছে। চারদিকে ডানার শব্দ তুলে পাখি উড়ছে, রঙিন পাখনায় ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি। ভেজা মাটি, ঠাণ্ডা ছায়া আর নিস্তব্ধতায় জায়গাটা ঘোর হয়ে আছে।
এক থোকা বুনো কুল তুলে একটা কুল মুখে পুরেছে মাত্র, অমনি বুরুন দেখতে পেল, পুকুরের ওধারে লুঙ্গিপরা খালিগায়ে একটা লোক তার দিকে স্থির চোখে চেয়ে আছে।
অবাক হওয়ার কথা। পুকুরের চার ধারেই গহিন জঙ্গল। এ-পুকুরের ধারে কাছেও কেউ আসতে পারে না। জল অব্যবহারে পচে সবুজ হয়ে আছে। কচুরিপানা হয়নি বটে, কিন্তু খুদে শ্যাওলায় জল ছেয়ে গেছে। ঘাট ভাঙা, পাড়ে জঙ্গল, চারদিকে কাঁটা আর বিছুটির ঘন বন। এ-জঙ্গলে কাঠ কুড়োতেও কেউ আসে না। তবে এ-লোকটা এল কোত্থেকে?
বুরুনও তাকিয়ে ছিল। তার মনটা খারাপ। নইলে সে লোকটাকে দেখে চমকে যেত কিংবা ভয় পেত। কিন্তু মন এতই খারাপ যে, বুরুন আর কোনো কিছুকে ভয় পাচ্ছে না। কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না আর।
বুরুন দেখল, লোকটা হঠাৎ পুকুরের ধার দিয়ে নেমে জলের ওপর পা রাখল। তারপর অনায়াসে জলের ওপর দিয়ে হেঁটে জোর কদমে চলে আসতে লাগল এদিকে। জলের ওপর কেউ হাঁটতে পারে, এ বুরুনের জানা ছিল না। দেখে সে অবাক। সায়েন্স তো একথা মানে না। গ্র্যাভিটেশনের নিয়ম আছে, স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি আছে। তবে?
যাই হোক, লোকটা কিন্তু হেঁটে চলে এল এপারে। পায়ের পাতাটাও ভেজেনি।
উঠে এসে লোকটা বড় বড় দাঁত বের করে হেসে বলল, “কি খোকা, ভয় পেয়েছ?”
বুরুন একটু অবাক হয়ে বলে, “ভয়? না, ভয় পাব কেন?
“পাওনি?” এবার লোকটাই অবাক।
“না, ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি শুধু সায়েন্সের কথা ভাবছিলাম, মনে হল সায়েন্স এখনো অনেক কথা জানে না?”
“তা বটে।” বলে লোকটা একটু হেসে লোকে যেমন টুপি খোলে, ঠিক সেভাবে নিজের মাথাটা ঘাড় থেকে তুলে এনে হাতে নিয়ে একটু ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করল চাঁদির জায়গাটা, তারপর মুণ্ডুটা আবার যথাস্থানে লাগিয়ে বলল, “মাথায় খুব উকুন হয়েছে কিনা, তাই চুলকোচ্ছে।”