আর সেই মুহূর্তে বাতাসে প্রচণ্ড কোলাহল করে ভূতেরা বলে উঠল, “হাবু, তুমি এবার মরো! হাবু, তুমি এবার মরো! হাবু, তুমি এবার মরো!” হুবহু করালীবাবুর নামতার সুর।
এক মুহূর্ত ‘থ’ হয়ে থেকে পরমুহূর্তেই হাবু বুঝতে পারল, তার মন্ত্র আর কাজ করছে না। যাদের সে বশ করে রেখেছিল এতকাল, তারা সব রুখে দাঁড়িয়েছে।
হাবুর জীবনে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। গদাই-দারোগার হাতে সে একবার বোকা বনেছিল বটে, কিন্তু তা বলে গদাই তার মন্ত্র কাটতে পারেনি। সাকাসের বাঘ ধরে এনে সাহসী গদাই তার পিঠে চেপে গোঁসাইবাগানে এমনভাবে দেখা দিয়েছিল যে, হাবু ভেবেছিল গদাই বুঝি বেজায় মন্ত্রসিদ্ধ গুণী লোক। ঘাবড়ে গিয়ে হাবু বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিল, তাই তার মন্ত্রতন্ত্র কাজ করেনি। কিন্তু তারপর জেলখানায় বসে গোপনে সে আরও চর্চা করে খুব ক্ষমতা নিয়ে ফিরেছে। কিন্তু সব গুলিয়ে গেল। আর কোনও জারিজুরি খাটবে না।
মুহূর্তের মধ্যে বুদ্ধি খাঁটিয়ে হাবু মশালটা বাঘের মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়ে পাশ কাটিয়ে চোঁ-চাঁ দৌড়তে লাগল। পিছনে তাড়া করে চলল ছ্যাঁকা-খাওয়া কালান্তক বাঘ। বাঘের পিছনে ভূতের পাল। আর তার পিছনে হাফপ্যান্ট-পরা মশাল হাতে করালী স্যার।
করালী স্যার তখনও চেঁচাচ্ছেন, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো…”
হাবু কিন্তু সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে যায়।
করালী স্যারের হাফপ্যান্ট-পরা করাল চেহারা আর বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো…’ চেঁচানি শুনেই বোধহয় বাঘটা জঙ্গলে পালিয়ে যায়। হাবু প্রাণভয়ে দৌড়ে গিয়ে একটা বাবলা গাছের শেকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। ভূতেরা যখন গিয়ে তার ঘাড় মটকানোর চেষ্টা করছে, তখন করালী স্যার “বুরুন, তুমি..” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সেখানে হাজির হলেন। তাঁর গায়ে কবিরাজমশাই যে তেল মাখিয়ে দিয়েছিলেন, সেই তেলের গন্ধে অধিকাংশ ভূতই তফাতে গিয়ে ‘ওয়াক’ তুলতে লাগল, বাদবাকি ভূতেরা বুরুন তুমি..’ চেঁচানিকে নতুন কোনও মন্ত্র ভেবে ভয় খেয়ে সরে দাঁড়াল।
তাই বেঁচে গেল হাবু। তবে বেঁচে গিয়েও তার হেনস্থার আর শেষ রইল না। ইস্কুলের বুড়ো দফতরি রিটায়ার হয়ে দেশে চলে যাওয়ায় সে-জায়গায় হাবুকে বহাল করা হল।
হাবু এখন ইস্কুলের ঘণ্টা বাজায়, ক্লাসে ক্লাসে পরীক্ষা বা ছুটির নোটিস দিয়ে যায়। সেই হাবু আর নেই। চুপসে এতটুকু হয়ে গেছে। ভূত-প্রেতকে সাঙ্ঘাতিক ভয়, দিনরাত রাম-নাম জপ করে।
কবিরাজমশাইয়ের যা পসার হয়েছে, তা আর বলার নয়। সারাক্ষণ তাঁর দোকানে রুগির ভিড়। তবে লোকে বলে যে, তাঁর রুগিদের মধ্যে সবাই মানুষ নয়।
খেলাধূলা বা লেখাপড়ায় বুরুনকে আর নিধিরাম সাহায্য করে না। রাম কবিরাজ নিষেধ করে দিয়েছেন। তবে বুরুন নিজের চেষ্টাতেই খেলা ও পড়ায় বেশ উন্নতি করে ফেলেছে। তবে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষাতেও দেখা গেল যে, সে অঙ্কে সেই তেরোই পেয়েছে। অথচ একশ নম্বরের উত্তর নির্ভুল দিয়েছিল।
পরে অবশ্য খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, করালীবাবু স্যার ক্লাসের সব ছেলেকেই অঙ্কে ঢালাও তেরো নম্বর করে দিয়েছেন। কাউকে পাশ করাননি। ছেলেরা গিয়ে যখন তাঁকে ধরল, তখন তিনি একগাল হেসে সকলের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, “তেরো নম্বরটা খুব পাওয়ারফুল। বুঝলে! আমি এখন তেরো সংখ্যাটা নিয়ে খুব ভাবছি। ভেবে মনে হল, সকলেরই জীবনে অন্তত একবার অঙ্কে তেরো পাওয়াটা খুব দরকার।”