দরজার পাল্লাটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একটা মশালের হলুদ আলো দেখা দিল দরজার ফাঁকে। এক মস্ত চেহারার রক্তাম্বর-পরা লোক পাথরের মতো মুখে মশাল উঁচুতে তুলে ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। তার পিছনে বিশাল ডোরাকাটা কালো-হলুদ বাঘ।
করালীবাবুর অবশ হাত থেকে জ্যাভেলিনটা পড়ে গেল মেঝেয়। বিস্ময়ে হাঁ করে আছেন, মাথাটা ফাঁকা।
বাঘটা ডাকল–ঘ্র-ড়-ড়-অ…
কী সাংঘাতিক রক্ত-জল-করা ডাক!
করালীবাবু অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। যেতেনই, তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে পুরো বাক্যটা মনে পড়ে গেল।
সঙ্গে-সঙ্গে করালীবাবু পাঠশালার সদার-পোড়োর মতো বিকট সুরে চেঁচাতে লাগলেন, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি…”
পাথরের মতো বিশাল চেহারার লোকটা এগিয়ে আসতে-আসতে হুঙ্কার দিল, “মা! মা গো! নর-রক্ত চাস মা? শব-সাধনা চাস মা? আজ তোর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।”
করালীবাবু সব ভুলে গেছেন, নিজের নামটাও মনে নেই। কিন্তু তিনি একনাগাড়ে নিখুত নামতার সুরে প্রাণপণে বলেই চলেছেন, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো..”
“ঘ্রা-ড়া-ড়া-ড়া-হু-উ-ম্!”
“তারা! তারা! মা!”
“ঘ্রা-ড়া-ড়া-হু-উ-ম!” বলে আর একবার ডাক ছেড়ে বাঘটা বিদ্যুৎ-বেগে লাফিয়ে পড়ল সামনে।
করালীবাবু শুধু টের পেলেন যে, বাঘটা তাঁর প্যান্টের কোমর কামড়ে ধরে পুঁটিমাছের মতো মুখে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর সেই বিশাল লোকটা হুঙ্কার দিয়ে বলছে, “তারা! তারা!”
করালীবাবু বাঘের মুখ থেকে ঝুলে থেকেও প্রচণ্ড চেঁচিয়ে বলে যেতে লাগলেন, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি…”
.
ছোট্ট একটা খেলনা-অ্যারোপ্লেনে করে বুরুন আর ভুতুম চাঁদের রাজ্যে চলে এসেছে। ভারি সুন্দর সোনালি মাঠ এখানে। সোনালি গাছপালা, সোনা রঙের ঘাস, আকাশে সোনা-ছড়ানো আলো।
চাঁদের বুড়ি চরকা থামিয়ে তাদের জন্য পিঠে বানাতে বসেছে। বুরুন আর ভুতুম চলল ততক্ষণে কাছের ছোট একটা রুপোলি পাহাড়ের জলে স্নান করতে।
চারদিকে পাখি ডাকছে। ময়ূর উড়ে বেড়াচ্ছে। মেঘের ভেলায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। চারদিকে খেলা, ম্যাজিক, চড়ইভাতি, সাকাস, আইসক্রিম। পড়াশুনোর বালাই নেই, ইস্কুল-পাঠশালা নেই। শুধু মজা আর মজা!
ভুতুম বলল, “বুরুনদা, আমরা কিন্তু কোনও দিন ফিরে যাব না!”
“দুর! কে ফিরবে?”
বুরুন আর ভুতুম ম্যাজিক দেখল, সাকাস দেখল, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলল, আইসক্রিম খেতে খেতে গিয়ে ঝরনার জলে ইচ্ছেমতো স্নান করল, ঝরনার নীচে একটা সুন্দর পুকুরে সাঁতার কাটতে লাগল।
হঠাৎ বুরুন শুনতে পেল, এত আনন্দ আর অফুরন্ত মজার মধ্যে কে যেন হঠাৎ রসভঙ্গ করে বলে উঠল, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো?”
দপ করে যেন চারদিকের আনন্দের আলোটা নিবে গেল বুরুনের চোখে। মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। চারদিকে চেয়ে কথাটা কে বলল, সে তা খুঁজছিল। সন্দেহবশে একটা পাখিকে ঢিল মেরে তাড়িয়ে দিল বুরুন। কিন্তু তবু কে যেন আবার বলে উঠল, “বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো?”
ভারি রেগে গেল বুরুন। ভীষণ চেঁচিয়ে বলল, “ভাল হবে না বলছি!”
কিন্তু আবার আড়াল থেকে, আবডাল থেকে, বাতাস থেকে, আকাশ থেকে কথাটা আসতেই লাগল, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো!”
রাগে বুরুন দশখানা হয়ে গেল। এক লাফে ঝরনার জল থেকে উঠে বড় বড় ঢিল তুলে চারদিকে ছোঁড়ে আর চেঁচায়, “ভাল হবে না বলে দিচ্ছি! সব ভেঙে ফেলব! সব নষ্ট করে দেব!”
পায়ের নীচে মাটি বলে উঠল, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো!”
পাহাড় বলে ওঠে, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো।”
তারপর সমস্বরে গাছপালা, পাখি, নদী, জল, চাঁদ, মেঘ সবাই নামতার সুরে বলতে থাকে, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন তুমি…”
রাগের চোটে বুরুন একটা গাছ উপড়ে নেয়! তারপর দুহাতে ধরে এলোপাতাড়ি চারদিকের সব কিছু ভাঙতে থাকে। আকাশ ভাঙে, পাহাড় ভাঙে, মাটি ভাঙে… ভাঙতে… ভাঙতে… ভাঙতে… চারদিকের সব ফাঁকা হয়ে যায়। …সব মিলিয়ে যায়।
পাতালঘরে আস্তে বুরুন চোখ মেলে তাকায়। তাকিয়েই বুঝতে পারে, তার ওপর এতক্ষণ যে স্বপ্নের ভার চাপানো ছিল, তা সরে গেছে!
তার কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বলে ওঠে, “বুরুন, এই প্রথম একজন নিজের শক্তিতে হাবুর মন্ত্র কেটে বেরিয়ে আসতে পারল। সাবাশ! হাবুর আর কোনও ক্ষমতাই রইল না। যেই মুহূর্তে হাবুর মন্ত্র তুমি কেটেছ, সেই মুহূর্তেই হাবুর সব শক্তি চলে গেছে।”
বুরুন বলল, “নিধিদা!”
কিন্তু নিধিরাম তখন কোথায়! পলকে বাতাসের বেগে সে ছুটে গেছে তার দলবলকে খবর দিতে।
সুড়ঙ্গ ধরে মশাল-হাতে হাবু উঠছিল ওপরে। সামনে ভয়াল বাঘ। বাঘের মুখে করালীবাবু ঝুলছেন। ঝুলতে ঝুলতে তখনও অস্ফুট স্বরে বলছেন “বুরুন, তুমি…”
হঠাৎ বাঘটা থেমে করালীবাবুকে যত্নের সঙ্গে মাটিতে শুইয়ে দিল। তারপর আস্তে-আস্তে ঘুরে হাবুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিশাল
হাঁ করে গম্ভীর স্বরে ডাকল, “ঘ্রা-ড়া-ড়া-হু-উ-ম!”
বাঘের দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে, জিভ দিয়ে নাল গড়াচ্ছে, গোঁফজোড়া কাঁটার মতো খাড়া হয়ে আছে।